যুবাইদা খানম বললেন, ওঁকে আমি চিনি। ওঁর বোনকে আমার চাচতো ভাই বিয়ে করেছে।
.
০২.
সাখাওয়াত হোসেনের তিন মেয়ে তিন ছেলে। তাদের মধ্যে সবার বড় খালেদা মেজ সামসুদ্দিন। তারপর নাসির উদ্দিন, শবনম, কলিম উদ্দিন ও সাবার ছোট আসমা। উনি খুব ধর্মভীরু লোক। কাস্টমস অফিসে চাকরি করলেও ঘুষ খান না। সেই জন্যে অফিস স্টাফরা ওঁকে সুফি সাহেব বলে বিদ্রূপ করে। আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে সত্যিই উনি সুফি। কিশোর বয়স থেকে লুঙ্গি অথবা পাজামা ও ঝুল পিরান এবং সব সময় মাথায় টুপি পরে থাকতেন। কখনো দাড়ী কামাননি। কোন দামী পোষাক পরেননি। ছাত্র জীবনেও ঐ পোষাকে স্কুল-কলেজে পড়েছেন। সে সময় সহপাঠিরা তাঁকে কাটমোল্লা আবার অনেকে সুফি সাহেব বলেও কটাক্ষ করত। পরবর্তিতে চাকরি জীবনেও ঐ একই পোষাকে অফিস করেছেন এবং এখনও করছেন।
ওঁর স্ত্রী যুবাইদা খানম দৌলতখান গ্রামের ধনী শিক্ষিত ফ্যামিলির একমাত্র মেয়ে। এইচ, এস,সি পাস করার পর বিয়ে হয়। ধনী ও শিক্ষিত ফ্যামিলির মেয়ে হলেও ধর্মীয় অনুশীলনে মানুষ হয়েছেন। তাই ধার্মিক স্বামী পেয়ে তিনি ধন্য। এই এলাকার প্রায় সবাই ধর্মের আইন-কানুন মেনে চলেন। মেয়েরা পর্দা মেনে চলে। স্কুল কলেজে পড়লেও বোরখা বা চাদর ব্যবহার করে। এসবের পিছনে ভারতের অধিবাসী পীরে কামেল হযরত মৌলানা কেরামত আলী জৌনপুরী(রাঃ)–এর বিরাট অবদান রয়েছে। শুধু এই এলাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব বঙ্গের) মুসলমানরা বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত মুসলমানরা যখন অজ্ঞতার কারণে বেদাঁতের মধ্যে ডুবে ছিল। তখন তিনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এসব অঞ্চলে সফর করে ইসলামের দ্বীপশিখা জ্বালাবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। মুসলমানদেরকে বেদাঁতের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোতে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের পশ্চিম বঙ্গের আরো একজন পীরে কামেলের অবদান রয়েছে। তিনি হলেন, ফুরফুরা শরীফের পীরে আলা হযরত মৌলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রাঃ)। আজও উনাদের বংশধরগণ বাংলাদেশ সফর করে মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনি এলেম প্রচার করার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
বর্তমান জৌনপুরের গদীনশীন পীর এখনো প্রতিবছর রমযান মাসে দৌলতখানে এসে মাসাধিক কাল থেকে ওয়াজ নসীহত করেন। দৌলতখান বাজারের দক্ষিণে বিরাট ঈদগাঁ। উনিই প্রতি বছর ঈদের নামাযের ইমামতি করেন। আশপাশের এবং বহু দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে ওঁর পিছনে ঈদের নামায আদায় করে।
সাখাওয়াত হোসেনের আসল বাড়ি ছিল হাজিপুর গ্রামে। এককালে দৌলতখান গ্রামের প্রায় বার মাইল পূর্বে মেঘনা নদী উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত ছিল। নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বর্তমানে সেই দূরত্ব এক মাইলের মত ঠেকেছে। গত দুবছর ভাঙ্গন বন্ধ রয়েছে। নচেৎ এতদিনে দৌলতখান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেত। গত কয়েক বছরে হাজিপুরসহ এই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম, সাহেবের হাটের দুই-তৃতীয়াংশ, সঈদপুর গ্রাম ও এই ইউনিয়নের বেশ কিছু অংশ, চৌকির হাট ও পুরো মেঘরা গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মেঘনা নদী পশ্চিম দিকের বহু গ্রাম যেমন গ্রাস করেছে তেমনি পূর্ব দিকে বড় বড় চরের সৃষ্টি করেছে। সেগুলোর নাম চর জহিরুদ্দিন, নলডোগী ও বৈকুণ্ঠপুর ইত্যাদি। এই চরের পূর্ব দিক দিয়েও মেঘনা প্রবাহিত। ওপারে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা। এই সব চরে দৌলতখান, হাজীপুর, সাহেবের হাটের মানুষেরা চাষাবাদ করে। ধান ও রবি ফসল প্রচুর জন্মায়। গরু, মহিষ হাঁস-মুরগি পালন করে। এখানকার উৎপন্ন সবকিছু দেশের বিভিন্ন জায়গায় লঞ্চ,স্টীমার ও গয়না নৌকায় করে পাঠান হয়। নদীর ভাঙ্গন রোধ করার জন্য সরকার দুবার উঁচু করে সুদীর্ঘ ভেড়ীবাঁধ দিয়েছিল। কিন্তু তা নদীগর্ভে চলে যায়। বর্তমানে যে ভেড়ীবাঁধ দেওয়া হয়েছে, তার দুপাশে চর ভাঙ্গা, অনেক গ্রামবাসী ঘোট ঘোট ঘর উঠিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যারা এককালে। বড় বড় গৃহস্থ ছিল। যাদের বিশ, পঞ্চাশ ও একশো বিঘা ক্ষেতি জমি ছিল, তারা আজ নিঃস্ব হয়ে অভাব অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন অতিবাহিত করছে। তাদের বেশির ভাগ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। কিছু সংখ্যক অবস্থাপন্ন লোক নদীর ভাঙ্গন দেখে দূর দূর গ্রামে জমি– জায়গা কিনে রেখেছিল। বাড়ি- ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার পর তারা সেখানে এসে বসবাস করছে। আবার অনেকে সবকিছু হারিয়ে দূর গ্রামের আত্নীয়– স্বজনদের সহায়তায় জমি– জায়গা কিনে বাড়িঘর করে বসবাস করছে।
সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যাওয়ার পর দৌলতখান শ্বশুর বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। বর্তমানে শ্বশুর-শ্বাশুড়ী কেউ বেঁচে নেই।
মোজাম্মেল খন্দকারের বাড়ি ছিল আলিপুর গ্রামে। তার একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছিল দৌলতখান গ্রামে। আলিপুর যখন নদীতে বিলীন হয়ে গেল তখন তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে বোনের বাড়িতে উঠেন। পরে ওঁর দুলাভাইয়ের বাড়ির অনতি দূরে তাদেরই জায়গায় ঘর উঠিয়ে বাস করছেন। এখানে আসার এক বছর পর ওঁর স্ত্রী চার বছরের এক ছেলে রেখে মারা যান। ঐ ছেলের নাম রহিম। মোজাম্মেল খন্দকারের এক চাচাতো বোনের বিয়ে হয়েছিল বাঠামারা গ্রামে। তার কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। উনি রহিমকে মানুষ করার জন্য নিয়ে যান। আল্লাহপাকের কি শান, রহিমকে নিয়ে যাওয়ার দুবছর পর তাদের ঘরে সন্তান জন্মাল। এখন তাদের দুছেলে দুমেয়ে। রহিম তাদের। কাছে থেকে ম্যাট্রিক পাস করে।