হ্যাঁ জানি।
আব্বা মারা যাওয়ার পর আর্থিক দূরবস্থার কারণে আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চাকরি করছি।
তা তো ভালই করেছ, এখন কি বিপদ তাই বল।
আতাহার ছোটবেলা থেকে শবনমের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা এবং আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবই বলল। তারপর আবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি এর একটা সুরাহা করে দিন।
চৌধুরী হুজুর আবার পা থেকে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি সুরাহা করবার কে? তুমি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। আর আমি যা বলব, তা যদি মেনে নাও, তা হলে ইনশাআল্লাহ এটার একটা সুরাহা হতে পারে।
আতাহার বলল, আপনি যা বলবেন, ইনশাআল্লাহ আমি মেনে নেব।
তা হলে শোন, শবনম ও তুমি এখন সাবালক হয়েছ। সাবালক ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে মেলামেশা করা হারাম। তুমি আর শবনমের সঙ্গে মেলামেশা করবে না এবং গোপনে বা প্রকাশ্যে দেখাও করবে না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কত বেতন পাও।
এক হাজার।
ঠিক আছে। আমি তোমাকে প্রতিমাসে দুহাজার টাকা দেব। তুমি ঢাকায় থেকে আবার পড়াশোনা শুরু কর। ঐ টাকা থেকে প্রতিমাসে তোমার আম্মাকে এক হাজার করে পাঠাবে, বাকী টাকায় তুমি পড়াশোনা করবে। আর শবনমের ভার আমি নিলাম। যখন আল্লাহপাকের মর্জি হবে তখন আমিই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। আর একটা কথা, এই সমস্ত কথা তুমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাউকে বলবে না। এমন কি শবনমকেও চিঠিপত্র দিয়ে জানাবে না। কি করবে না করবে এখনই বলতে হবে না। দুএকদিন চিন্তা করে আমাকে জানাবে। কিন্তু খবরদার, আবার বলছি, এসব কথা কাউকে বলবে না।
এমন সময় আলমাস সেখানে এলে তাকে বললেন, আতাহারকে কিছু নাস্তা খেতে দাও। তারপর আতাহারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওর সঙ্গে যাও।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষণ ভাবছিল, সে কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? এরকম মানুষও তা হলে দুনিয়াতে আছে? ওঁর শেষ কথা শুনে ওঠে সালাম জানিয়ে আলমাসের সঙ্গে চলে এল।
আলমাস তাকে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে নাস্তা খেতে দিয়ে বলল, চৌধুরী হুজুর কি বললেন?
আতাহার বলল, সে কথা বলতে পারব না। তারপর নাস্তা খেয়ে চলে এল।
সে রাতে আতাহার ঘুমাল না। চৌধুরী হুজুরের কথা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সারারাত কোরআন তেলাওয়াত ও নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল, সে যেন চৌধুরী হুজুরের কথা পালন করতে পারে।
সারারাত জাগার ফলে আতাহার সকালে খুব ক্লান্ত বোধ করল। গোসল করে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেদিনের পর থেকে ছেলের মন খুব খারাপ দেখে রফিকা বেগমেরও মন খারাপ। তাকে আশ্বাস দেবার কোন উপায় না দেখে নিজেকে শক্ত করে রেখেছেন। কাল আতাহার ঢাকা চলে যাবে তা জানেন। তাই রাত্রে এক ঘুমের পর তাকে এবাদৎ বন্দেগী করতে দেখে বললেন, কাল তুই ঢাকা যাবি, লঞ্চে ঘুমাতে পারবি না। এবার ঘুমিয়ে পড় বাবা।
আতাহার বলল, তুমি ঘুমাও আম্মা, আজ আমার ঘুম হবে না।
রফিকা বেগম মনে করলেন, মানসিক উত্তেজনায় তার ঘুম আসছে না। তাই এবাদৎ করে সময় কাটাচ্ছে। আর কিছু না বলে ছেলের কোরআন পড়া শুনতে শুনতে এক সময় আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে তাকে নাস্তা খেয়ে ঘুমাতে যেতে দেখে বললেন, সারারাত ঘুমাসনি। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নে; আমি সময় মতো জাগাবো। খেয়ে দেয়ে তারপর রওয়ানা দিবি।
আতাহার বলল, আমাকে জাগিও না। ভাবছি দুএকদিন পর ঢাকা যাব।
রফিকা বেগম আতঙ্কিত হয়ে এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন, কেন রে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
না আম্মা, তা নয়। দুদিন পরে গেলেও কোনো অসুবিধা হবে না। তাই আজ যাব না।
রফিকা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে দুদিন পরেই যাস।
সেদিন আতাহার বাইরে কোথাও গেল না। সন্ধ্যের পর কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াতে বসল। এক সময় কুলসুমকে বলল, নাসির উদ্দিন আর তোদেরকে পড়াবে না। আমি তোদের স্কুলের একজন ম্যাডামের কাছে ছুটির পর পড়ার ব্যবস্থা করে দেব।
কুলসুমের এখন সবকিছু বোঝার বয়স হয়েছে। শবনমের সঙ্গে ভাইয়ার সম্পর্কের কথা জানত না। যেদিন যুবাইদা খানম এসে রফিকা বেগমকে ঐসব কথা বললেন, সেদিন, জেনেছে। আর সেই জন্যে নাসির উদ্দিন যে পড়াতে আসেনি, তাও বুঝেছে। এখন ভাইয়ার কথা শুনে বলল, আমাদের ইংলিশের ম্যাডাম খুব ভালো। তুমি তার কাছে পড়বার ব্যবস্থা করো।
আতাহার বলল, ঠিক আছে, তাকেই আগে বলব, রাজি না হলে অন্য ম্যাডাম ঠিক করব।
পরের দিন আতাহার বোনদের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে ইংলিশ ম্যাডামের কাছেই পড়াবার ব্যবস্থা করে এসে মাকে সে কথা জানাল।
রফিকা বেগম বললেন, তোর বেতনের টাকায় এমনিতেই কত কষ্টের সঙ্গে সংসার চালাচ্ছি। ওদের প্রাইভেট মাস্টারের বেতন দেব কি করে?
আতাহার বলল, সামনের মাস থেকে ওদের প্রাইভেট মাস্টারের টাকাও পাঠাব।
রফিকা বেগম বললেন, তা হলে ভালই করেছিস।
বিকেলে আসরের নামায পড়ে আতাহার চৌধুরী হুজুরের কাছে গেল।
চৌধুরী হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, কি সিদ্ধান্ত নিলে?
আতাহার বলল, বেয়াদবি মাফ করবেন। সে কথা বলার আগে দু একটা কথা জানতে চাই।
বেশ তো বল।
আপনি আমার জন্য এতকিছু করবেন কেন? আমি শুধু শবনমের ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছি। আমাদের অভাব অনটন থাকলেও আল্লাহ তো না খাইয়ে রাখেন না। বরং অনেকের চেয়ে আল্লাহ আমাদেরকে অনেক সুখে রেখেছেন। আপনার এই অযাচিত দান নেওয়া কি আমাদের জায়েজ হবে?