মুবিনের চিঠি পেয়ে তার বড় ভাবি সুরাইয়া খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সে-ই শবনমকে পছন্দ করে স্বামী ও শ্বশুরদের বলে এতোটা এগিয়েছে। এখন শুধু বিয়ের দিন ঠিক করা বাকি। চিন্তা করল, এবার মুবিন বাড়িতে আসার পর যখন শবনমের সঙ্গে বিয়ের কথা বললাম তখন তো তাকে বেশ খুশি খুশি মনে হল। এখন আবার কি এমন হল যে, বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বলছে? তা হলে কি এর মধ্যে মুবিন ভোলাতে কোনো মেয়ে পছন্দ করেছে? কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে ঐ দিন রাতে ঘুমোবার সময় কথাটা স্বামীকে জানাল।
মুবিনের বড় ভাই লতিফ। স্ত্রীর কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
সুরাইয়া অধৈর্য গলায় বলল, কিছু বলছ না যে?
লতিফ বলল, কি আর বলব, মুবিন যদি এখন বিয়ে করতে না চায়, তা হলে আমরা তো জোর করে বিয়ে দিতে পারি না?
তা না হয় ঠিক, কিন্তু এত কিছুর পর বিয়ে ভেঙ্গে দিলে ভাবি ও তার বাবা-মা কী ভাববেন? তা ছাড়া আব্বাকে কথাটা কে জানাবে?
কেন? তুমি জানাবে। তুমি যখন সবকিছুর উদ্যোক্তা তখন তোমারই জানান উচিত।
আমি পারব না। ছি, ছি, মুবিন ভাইটা যে কী, আমি ভাবতেই পারছি না। তাই যদি মনে ছিল, কথাবার্তা হওয়ার পর-পরই জানাতে পারত।
কেন জানাল না, তা তোমার আদরের দেবর জানে। তুমিই তো তাকে সব থেকে বেশি লাই দাও। এখন তার ঠেলা তোমাকেই সামলাতে হবে।
আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু জানাতে পারব না।
একান্ত তুমি না পারলে, আমাকেই জানাতে হবে। হাজার হোক মুবিন আমাদের সবার ছোট। ছোটদের ন্যায় অন্যায় বড়দেরকে সামলাতে হয়। এখন রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়। কাল যা করার আমি করব।
পরের দিন লতিফ মুবিনের অমতের কথা মা-বাবাকে জানিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে তাদেরকেও জানিয়ে এল।
কথাটা শুনে খালেদার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। স্বামীকে বলল, মুবিনের বিয়েতে অমতের কারণ কিছু বুঝতে পারছ?
মজিদ বলল, না, তবে মনে হয় সে কোনো মেয়েকে ভালবাসে?
খালেদা বলল, তা হলে শবনমের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার পরপর অমত করল না। কেন?
মজিদ বলল, তখন হয়তো সেই মেয়ের সঙ্গে তেমন ভালবাসা জমেনি।
তোমার যেমন কথা। আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।
না হলে আমি কি আর করবো?
তুমি একবার ভোলায় গিয়ে মুবিন বিয়াইয়ের সঙ্গে দেখা কর।
তা সম্ভভ নয়। এটা কি দাওয়াত খাওয়ার ব্যাপার? রাগ করে না এলে তোষামোদ করে আনব। বিয়ে-শাদীর ব্যাপার জোর করে কিছু করা যায় না। পাত্র রাজি থাকলে তার মা-বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান যায়। কিন্তু পাত্র যেখানে নিজেই অরাজি সেখানে কিছু করতে যাওয়াটা বোকামী।
কিন্তু আম্মা-আব্বাকে খবরটা তো জানাতে হবে?
তুমিই যখন এটার সবকিছু করেছ তখন তুমিই গিয়ে জানিয়ে এস।
আমি কোন মুখ নিয়ে তাদের কাছে যাব?
যেতে না পারলে চিঠি দিয়ে জানাও।
আচ্ছা তুমি কি বলত? তোমার শালীর বিয়ে ভেঙ্গে গেল, আর তুমি কোনো গুরুত্ব। দিচ্ছ না। শালীর প্রতি তোমার কি কোনো দায়িত্ব নেই?
মজিদ হেসে উঠে বলল, পাত্র-পাত্রীর অমতে জোর করে বিয়ে দিলে বুঝি দায়িত্ব পালন করা হত। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি আমার কাছে সব কিছু গোপন। করলেও আমি জানতে পেরেছি, শবনমের অমতে তুমি তোমার মা-বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছ। এমন কি আমার কাছেও সব কিছু গোপন করেছ। তুমি শিক্ষিত ও ধার্মিক পরিবারের মেয়ে। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। স্বামীর কথা শুনে খালেদা নিজের ভুল বুঝতে পারল। আরো বুঝতে পারল যে, তার উপর স্বামী মনে মনে রাগ করেছে এবং মনেও কষ্ট পেয়েছে। তাড়াতাড়ি স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে না জানিয়ে অন্যায় করেছি। আমাকে মাফ করে দাও।
মজিদ তাকে বুকে জড়িয়ে আদর দিয়ে বলল, যে কোনো বিষয়ে স্ত্রীর উচিত, স্বামীকে জানান। যে সব স্ত্রীরা তা করে না, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক আর থাকে না, অনেক হালকা হয়ে যায়। তুমি যে নিজের অন্যায় বুঝতে পেরেছ, তাতে আমি খুশি হয়েছি।
খালেদার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, বল মাফ করে দিয়েছ?
মজিদ তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, স্কুলে দেখার পর থেকে অনেক বছর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে তোমাকে পেয়েছি। তোমার সব অন্যায় আমার কাছে। ক্ষমার যোগ্য। তা ছাড়া যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধনের চেষ্টা করে, তাকে আল্লাহ মাফ করে দেন এবং তাকে ভালবাসেন। আর তুমি তো আমার প্রাণাধিকা স্ত্রী। তোমাকে মাফ না করে কি পারি? এবার তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি শবনমের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিও না। আল্লাহপাক যার সঙ্গে যার জোড় রেখেছেন, তার সঙ্গে তার বিয়ে হবেই। ধনী ঘরের শিক্ষিত রোজগারী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলেই যে, মেয়ে সুখী হবে, এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। সমাজে কত ধনী লোক গরিব হচ্ছে। আবার কত গরিব লোক ধনী হচ্ছে; এরকম তো কতই দেখা যায়। এই তোমার আব্বার কথাই ধর না; ওঁর আব্বার আগে কত জায়গা-জমি ছিল। নদীতে সব ভেঙ্গে যাওয়ার পর একরকম নিস্ব হয়ে শ্বশুর বাড়ীতে এসে উঠেন। শ্বশুরের সম্পত্তি না পেলে ওঁর অবস্থা কি হত, চিন্তা করে দেখ। আল্লাহপাকের ঈশারায় অবস্থা আজ কত ভালো। শবনম যে ছেলেটাকে ভালবাসে তার বাপেরও ঐ একই অবস্থা। তারপর তার আব্বা মারা যাওয়ার পর তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আল্লাহপাকের ঈশারা থাকলে ভবিষ্যতে ঐ ছেলের অবস্থা ফিরে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ প্রত্যেক মা-বাবা মেয়েকে স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত ও রোজগারী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। তাই বলে সাবালিকা মেয়ের অমতে জোর করে কিছু করা উচিত নয়।