ওয়াহাব খাচ্ছিল, তাই সালাম না দিয়ে মুবিন জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছেন?
ওয়াহাব বলল, আল্লাহ চাহেত ভালো। আসুন বসুন। তারপর খাওয়া বন্ধ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, নাসিমা, মুবিন ভাইয়ের জন্য কিছু নিয়ে আয়।
মুবিন বলল, আপনি খান, আমি অফিস থেকে বেরিয়ে হোটেলে নাস্তা খেয়ে এসেছি। তারপর নাসিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার জন্য কিছু আনবেন না।
নাসিমা কিন্তু শুনল না। এক কাপ চা এনে মুবিনের হাতে দেওয়ার সময় বলল, হোটেলে নাস্তা খেলেও চা খাননি। তাই নাস্তা না দিয়ে শুধু চা দিলাম। আশা করি, হোটেলের চা খেতে না পারলেও এটা পারবেন।
নাসিমার কথা শুনে মুবিনের মনে হল, তার সঙ্গে যেন অনেক দিনের আলাপ পরিচয়। আরো মনে হল, মেয়েটি শিক্ষিত। বেশ অবাক হয়ে বলল, চায়ের ব্যাপারটা আপনি জানলেন কি করে?
নাসিমা কিছু বলার আগে ওয়াহাব বলল, আপনার সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচয় হল, সেদিন হোটেলে নাস্তা খাওয়ার পর চায়ের অর্ডার দিতে আপনি বলেছিলেন, হোটেলের নাস্তা খেতে পারলেও চা খেতে ভালো লাগে না বলে খান না। একদিন বাড়িতে আপনার কথা আলোচনা করার সময় কথাটা বলেছিলাম।
মুবিন আর কিছু না বলে চা খেয়ে কাপ পিরীচ টেবিলের উপর রেখে দিল।
ততক্ষণে ওয়াহাবেরও খাওয়া শেষ হয়েছে। নাসিমা ট্রেতে সব কিছু তুলে নিয়ে চলে গেল।
মুবিন ওয়াহাবকে বলল, আপনাদের বাড়ির সব মেয়েদের থেকে ওঁকে একটু অন্য রকম মনে হল।
ওয়াহাব মৃদু হেসে বলল, আমারই ভুল হয়েছে। সবার সঙ্গে পরিচয় করালেও নাসিমার সঙ্গে করান হয়নি। ও আমাদের একমাত্র বোন। বি, এ, পড়ছে। সবার ছোট। ও আমার মতো কমিউনিজমের ভক্ত ছিল। আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে আমার মনের কালিমা যেমন আল্লাহপাক দূর করে ইসলামের আলোয় আলোকিত করেছেন। তেমনি নাসিমাও আমার কাছ থেকে আপনার কথা শুনে ও ইসলামী বই পুস্তক পড়ে আমার থেকে বেশি ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছে এবং আমার থেকেও বেশি ধার্মিক হয়ে গেছে। তারপর নাসিমাকে ডাকার জন্য একটু উচ্চস্বরে বলল, নাসিমা, এখানে একবার আয়তো।
নাসিমা ট্রে রেখে ফিরে এসে ভাইয়াকে বলল, কেন ডাকলে বল,
ওয়াহাব বলল, তুই তো আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার জন্য কতবার তাকে আনতে বলেছিলি। আমার এমনই ভোলা মন, মুবিন সাহেব কতবার আমাকে দেখতে এলেন, সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম অথচ তোর সঙ্গেই পরিচয় করাইনি। অবশ্য সে সময় তুই ছিলি না। যাকগে, এখন পরিচয় করিয়ে দিই।
নাসিমা বলল, তার আর দরকার নেই। ওঁকে দেখেই আমি চিনেছি। তারপর মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, আপনার কথা ভাইয়ার মুখে অনেক শুনেছি। তাই আপনাকে দেখে চিনে ফেলেছি। আমার কথা ভাইয়ার কাছে নিশ্চয় শুনেছেন?
আগে শুনিনি, একটু আগে শুনলাম।
নাসিমা ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, আর কিছু বলবে?
কি আর বলব, যা বলতে চেয়েছিলাম, তার আর দরকার নেই।
তা হলে এবার য়ুই?
হ্যাঁ যা।
নাসিমা মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, আবার আসবেন। নাকি বন্ধু সুস্থ হয়ে গেছে। বলে আর আসবেন না?
মুবিন আজ আসার পর ওয়াহাবকে সুস্থ দেখে ভেবেছে, আর আসার দরকার নেই। তার মনের কথা নাসিমা জানতে পারল কেমন করে ভেবে খুব অবাক হল। কয়েক সেকেণ্ড তার চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আল্লাহপাকের ঈশারা থাকলে আসব।
সেদিনের পর থেকে মুবিনের ওয়াহাবদের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যায়নি। ওয়াহাব তাকে কতবার নিয়ে যেতে চেয়েছে। এমন কি নাসিমা ডেকেছে বলার পরও যায়নি। কারণ প্রথম দিন নাসিমার চোখের দিকে চেয়ে যে অনুভুতি অনুভব করেছিল, শেষ দিন তার সঙ্গে পরিচয় হবার পর সেই অনুভুতি আরো বেড়েছে। অন্য কোন ছেলে হলে হয়তো নাসিমাকে দেখার জন্য নিজের ইচ্ছায় যেত। কিন্তু মুবিন খুব সংযমী ছেলে। ইচ্ছাকে দমন করার ক্ষমতা তার প্রচুর। এর কয়েকদিন পর বাড়িতে গিয়ে যখন শুনল, ভাবির ভাইয়ের শালীর সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে তখন থেকে নাসিমার কথা মনে পড়লেও গুরুত্ব দেয়নি।
আজ মুবিন অফিসে শবনমের চিঠি পেল। অবশ্য চিঠিটা যে শবনমের তা জানতে পারল না। কারণ খামের উপর প্রেরকের ঠিকানা নেই। তাই তেমন গুরুত্ব না দিয়ে রেখে দিল।
ছুটির পর বাসায় এসে চা-নাস্তা খেয়ে চিঠিটা পড়ল। পড়ে মুবিন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার কি করা উচিত ভাবতে লাগল। শবনম ছোট বেলায় যখন তার আপার বাড়িতে এসেছে তখন অনেকবার তাকে দেখেছে। সে সময় তার সঙ্গে কথাবার্তা না বললেও গতবছর তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারপর কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে যখন শুনল, শবনমকে বড় ভাবীর ও আব্বার খুব পছন্দ এবং তাকে ছোট পুত্রবধূ করার। ব্যবস্থা করেছেন তখন মনে মনে খুশিই হয়েছিল। তাই ওয়াহাব তাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে, নাসিমার সঙ্গে দেখা হতে পারে ভেবে ছয় মাস হতে চলল, যায়নি। আজ শবনমের চিঠি পড়ে কি করবে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ নাসিমার কথা মনে পড়ল। ভাবল, তা হলে কি এর মধ্যে আল্লাহপাকের কোনো ঈশারা আছে? কথাটা ভেবে মনে কিছুটা শান্তি অনুভব করল।
মুবিনরা তিন ভাই তিন বোন। মুবিন সবার ছোট। অন্যান্য সব ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। মুবিন শবনমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিল, এই চিঠির কথা সারাজীবন গোপন রাখবে। শুধু শুধু ওদের দুজনের জীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না। বড় ভাবীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিল, কোনো বিশেষ কারণে আমি এখন বিয়ে কবর না। তুমি আব্বাকে কথাটা জানিয়ে দৌলতখানে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দাও।