ঐ ছেলেটার নাম মফিজুর। বড় লোকের ছেলে। বলল, মেরেছি বেশ করেছি, তাতে তোর কি?
আতাহার তাকে একটা ঘুসি মেরে বলল, তুই কি মনে করেছিস ওর কেউ নেই?
মফিজুর মার খেয়ে পাল্টা মারামারি শুরু করল। দুজনে মারামারি করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল।
এমন সময় হেড মাস্টার দেখতে পেয়ে বেত নিয়ে এসে দুজনকেই দুচার ঘা লাগিয়ে বললেন, তোমরা স্কুলে কি মারামারি করতে এসেছ? তারপর তাদেরকে যার যার ক্লাসে যেতে বললেন।
তারপর থেকে শবনম আতাহারের সঙ্গে স্কুলে ও বাড়িতে খেলাধুলা করে। আতাহার প্রায় প্রতিদিন শবনমদের বাসায় যায়। শবনমকেও মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এক সঙ্গে খেলাধুলা ও স্কুলে লেখাপড়া করে মানুষ হচ্ছে। কখনো নদীর পাড়ে ছুটোছুটি করে। তবে বেশিরভাগ দিন তারা চৌধুরীদের বাগানে খেলাধুলা করে। এখন আতাহার এইটে আর শবনম সিক্সে পড়ে।
শবনমের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়ে আতাহার তার মাকে বলল, চাচীআম্মা, আপনি নাকি শবনমকে আমার সঙ্গে খেলতে বারণ করেছেন?
যুবাইদা খানম আতাহারকে চেনেন। তার ফুফু ওনার চাচাতো ভাবি। তা ছাড়া যেদিন স্কুলের একটা ছেলে শবনমকে মেরেছিল এবং সে জন্য আতাহার সেই ছেলেটার সাথে মারামারি করেছিল, তা জানার পর থেকে তাকে বড় স্নেহ করেন। বললেন, না বাবা মানা করিনি। তবে চৌধুরীদের বাগানে যেতে নিষেধ করেছি। ওখানে জ্বীন আছে।
আতাহার বলল, আমরা তো অনেক দিন থেকে ওখানে খেলাধুলা করি, কই একদিনও তো জ্বীন দেখলাম না।
যুবাইদা খানম হেসে উঠে বললেন, পাগল ছেলের কথা শোন, জ্বীনদেরকে কি মানুষ দেখতে পায়? ওরা আগুনের তৈরি। ওদেরকে মানুষ সহসা দেখতে পায় না। তোমরা যখন খেলাধুলা কর, তখন হয়তো জ্বীনেরা সেখানে থাকে না। যেদিন তাদের সামনে পড়ে যাবে, সেদিন তোমাদের ক্ষতি করবে। তোমরা ছেলে মানুষ। তোমাদেরকে একা পেলে মেরে ফেলতে পারে। খবরদার আর কোনোদিন ওখানে খেলতে যাবে না।
আতাহার বলল, ঠিক আছে, আপনি যখন নিষেধ করছেন তখন শবনমকে নিয়ে আর যাব না; কিন্তু আমি একা যাবই। আমি জ্বীন-টীন কাউকে ভয় করি না।
যুবাইদা খানম আতঙ্কিতস্বরে বললেন, না বাবা না, তুমিও যেও না। ওদের সামনে পড়ে গেলে তোমার ক্ষতি করবে।
এমন সময় শবনমের বাবা সাখাওয়াত হোসেন, সেখানে এসে স্ত্রীর শেষ কথা শুনতে পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে কার সামনে পড়ে গেলে ক্ষতি করবে?
যুবাইদা খানম বললেন, শবনম আর আতাহার চৌধূরীদের বাগানে খেলতে যায়। তাই ওদেরকে জ্বীনের ভয় দেখিয়ে যেতে নিষেধ করলাম।
সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রামে কাস্টমস অফিসে চাকরি করেন। দুই তিন মাস অন্তর বাড়িতে আসেন। এক সপ্তাহ থেকে চলে যান। তাই গ্রামের সবাইকে চেনেন না। স্ত্রীর কথা শুনে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। চৌধুরীদের বাগানে জ্বীন থাকে। তারপর আতাহারের দিকে চেয়ে বললেন, এই খোকা, তুমি কার ছেলে?
মোজাম্মেল খন্দকারের।
ও তুমি তা হলে খন্দকার বংশের ছেলে? তোমার আব্বা কি জাহাজে চাকরি করেন?
জ্বি?
উনি চট্টগ্রামে থাকেন না?
জ্বি বলে আতাহার বলল, আমি এখন যাই তা হলে?
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, হ্যাঁ, আবার এস। আর শোন তোমরা কিন্তু আর চৌধুরীদের বাগানে খেলতে যাবে না।
জ্বি আচ্ছা বলে আতাহার চলে গেল।
আতাহার চলে যাওয়ার পর সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ কিছু দিন আগের ঘটনা, বাড়ি আসব বলে আমি একদিন রিয়াজুদ্দিন বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। একটা দোকানে সওদাপাতি কিনে পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা নেই। এ পকেট সে পকেট হাতড়েও পেলাম না। ভাবলাম, বাসে আসার সময় পকেটমার হয়ে গেছে। টাকাটার জন্য যা না দুঃখ হল, দোকানদারের কাছে অপমান হতে হবে ভেবে তার চেয়ে বেশি লজ্জা হতে লাগল। আমার অবস্থা দেখে দোকানদার বললেন, কি ভাই মনে হচ্ছে, টাকা খোয়া গেছে? আমি বললাম, দুটো পাঁচশ টাকার নোট পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, মনে হয় বাসে পকেট মেরে দিয়েছে। আপনি মালগুলো বেঁধে এক সাইডে রেখে দিন, আমি বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসি।
আমি যখন সওদার অর্ডার লিখাচ্ছিলাম তখন একজন লোক সদাই করে ব্যাগে ভরছিলেন। তিনি তখনও সেখানে ছিলেন। পকেটমার হয়ে গেছে শুনে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার বাড়ি দৌলতখান না?
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, ত্যা কেন বলুন তো?
লোকটি বললেন, আমার বাড়িও দৌলতখান। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমার নাম মোজাম্মেল খন্দকার। আপনার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না।
আমি নাম বলে বললাম, এখানে কাস্টমস অফিসে চাকরি করি। দেশের বাড়িতে কম থাকি। সবাইকে তেমন চিনি না।
লোকটি বললেন, আমি এখানে জাহাজে চাকরি করি, দেশে কম থাকি। তবু কিন্তু আপনাকে দেখেই চিনেছি। তারপর দোকানদারকে বললেন, ওঁর কত টাকার সওদা।
দোকানদার স্লিপ দেখে বললেন, সাড়ে আটশো।
খন্দকার টাকাটা দোকানদারকে দিয়ে আমাকে বললেন, সওদাগুলো নিয়ে নিন ভাই। টাকাটা আমাকে এক সময় দিয়ে দেবেন। তারপর ঠিকানা দিয়ে বললেন, সময় করে একদিন আসবেন।
আমি পরের দিন তার বাসায় গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসি।