ইতি আপনার শুভাকাখিনি
শবনম।
চিঠি লেখা শেষ করে দুবার পড়ল। তারপর ভাজ করে বইয়ের মধ্যে রেখে ভাবল, কাল কোচিং করতে যাওয়ার সময় পোস্ট করবে।
.
০৭.
শবনম যাকে চিঠি দিল, তার নাম আব্দুল মুবিন। ডাক নাম মুবিন। মুবিন ঢাকা থেকে এম, এ পাশ করে ভোলায় সোনালী ব্যাংকে চাকরি করে। সেখানে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে। ধার্মীক ও সৎ ছেলে হিসাবে ছোটবেলা থেকে তার একটা সুনাম আছে। যতদিন গ্রামের বাড়িতে ছিল, ততদিন গ্রামের বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভোলাতে এক বছর মাত্র আছে। এরই মধ্যে সেখানে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ ও ধর্মীয় সংগঠনের সদস্য হয়ে কাজ করছে। তার কর্ম ও উন্নত চরিত্র দেখে সেখানকার অনেক উচ্চপদস্থ সরকারী লোকজন তাকে জামাই করতে আগ্রহী। কিন্তু মুবিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেয়, এসব ব্যাপারে আমার অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ইদানিং সমাজ কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারী ওয়াহাবের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ওয়াহাব ভোলারই ছেলে। ডাক্তারী পাশ করে ভোলা সদর হাসপাতালে ডাক্তারী করছে। এখনো বিয়ে করেনি। ধর্ম সম্বন্ধে যেমন কিছু জানত না, তেমনি ধর্মকে খুব এড়িয়ে চলত। বলত, চরিত্রবান হয়ে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করা অথবা উপকার করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আরো বলত, যারা ধর্মের কিছু আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলে, অথচ মানুষের উপকার করে না, যারা মানুষকে ঠকায়, মানুষের ক্ষতি করে, তারা আবার কিসের ধার্মীক? ঐ রকম ধার্মীক লোকদের আমি ঘৃণা করি। তাদের চেয়ে অধার্মীক লোক অনেক ভালো।
মুবিনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রথম দিকে এসব নিয়ে তার সঙ্গে ওয়াহাবের খুব তর্ক-বির্তক হত। মুবিন তার কথা স্বীকার করে নিয়ে যখন ইসলামের, কোরআনের ও হাদিসের ব্যাখ্যা তাকে বোঝাতে লাগল তখন ধীরে ধীরে তার জ্ঞানের চোখ-খুলে যায় এবং ইসলামের দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে মেনে চলতে শুরু করে। ওয়াহাব কমিউনিজমের সবকিছু ফলো করত। মুবিন তাকে বোঝালো কমিউনিজমের কাঠামো ইসলাম থেকে নেয়া এবং তারা ইসলামের দুষমন বলে ইসলামকে স্বীকার করে না। উদাহরণ স্বরূপ বলল, ধর কমিউনিজম ছোট-বড়-ধনী গরিব স্বীকার করে না। তারা বলে মানুষ সব সমান। কেউ গাছ তলায়, ফুটপাতে ও কুঁড়ে ঘরে থেকে একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাবে, আবার কেউ বড় বড় অট্টালিকায় ভোগবিলাসে জীবন যাপন করবে, তা হতে পারে না। আর ইসলাম কি বলে জানেন, পৃথিবীর মানব গোষ্ঠীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এবং সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য আল্লাহপাক ছোট বড়, ধনি-গরিব তৈরি করেছেন। সেই সঙ্গে ধনি-গরিব, ছোট-বড় সকলের জীবন ব্যবস্থার আইন কোরআন ও হাদিসে বাতলে দিয়েছেন। সেই সব আইন যদি মানবগোষ্ঠী মেনে চলত, তা হলে ছোটরা বড়দের বিরুদ্ধে এবং গরিবরা ধনীদের উপর এত অত্যাচার করত না। অথবা শোষণের স্টীম রুলার চালাত না। ক্বোরআন এবং হাদিসের ব্যাখ্যা পড়লে মুসলমানদের জন্য দুঃখে আপনার চোখ থেকে শুধু পানি নয়, রক্ত বেরিয়ে আসবে। কোরআন-হাদিসের একটা বাণী আপনাকে বলছি, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই এবং পৃথিবীর সমস্ত মুসলমান শুধু যে ভাই ভাই তা নয়, তাদের সমষ্টি মিলে একটা শরীর। শরীরের যে। কোনো অংশে ব্যথা লাগলে যেমন সমস্ত শরীরে তা অনুভুত হয়, তেমনি যে কোন মুসলমান দুঃখ কষ্টে বা বিপদে পড়লে সারা পৃথিবীর মুসলমানদের সেই দুঃখ কষ্ট বা বিপদ অনুভুত হবে এবং তার প্রতিকার করার জন্য সাহায্যার্থে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এক মুসলমানের ধন-সম্পত্তি অন্য মুসলমানদের কাছে আমানত স্বরূপ। আমানত যেমন খেয়ানত করা হারাম তেমনি এক মুসলমানের ধন-সম্পত্তি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা বা গ্রহণ করা হারাম। এমন কি কোন বিধর্মীও যদি বিপদে পড়ে, তাকে সাহায্য করা। মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব এবং তাদের ধন-সম্পত্তিও অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা হারাম। বিধর্মীরাও আল্লাহপাকের সৃষ্টি। কিন্তু মুসলমানরা কি কোরআন হাদিসের ঐসব আইন মানছে? মানছে না। তাই তো সারা দুনিয়ার মুসলমানরা আজ বিজাতীয়দের কাছে ঘৃণিত; লাঞ্ছিত ও উৎপীড়িত। এই পর্যন্ত বলে মুবিন বলল, আপনি কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ুন, আর সেই সঙ্গে নবী রসুল ও বিভিন্ন ইসলামী মণীষীদের জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন, ইসলামের কাছে পৃথিবীর কোনো ইজমই পাত্তা পাবে না।
মুবিনের সঙ্গে মেলামেশার ফলে এবং কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে ওয়াহাবের মনের কালিমা দূর হয়েছে। এখন সে ধর্মের অনেক নিয়ম মেনে চলে।
একবার ওয়াহাব অসুখে বেশ কিছুদিন বিছানায় পড়েছিল। খবর পেয়ে মুবিন কয়েকবার তাকে দেখতে গিয়েছিল। ওয়াহাবদের বাড়ির সবাই খুব মডার্ন। মেয়েরা ধর্ম কর্ম তো করেই না এমন কি পর্দা কি জিনিস তাও জানে না। মুবিন যেদিন ওয়াহাবকে প্রথম দেখতে যায় সেদিন তাদের বাড়ির মেয়েরা তাকে ওয়াহাবের বন্ধু জেনে অবাধে মেলামেশা করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন যায় তখন হঠাৎ মুবিন লক্ষ্য করল, গায়ে মাথায় চাদর জড়ান, এমন কি চোখ দুটো ছাড়া মুখও ঢাকা একটা মেয়ে অন্যান্য মেয়েদের সাথে ওয়াহাবের খাটের কাছে রয়েছে। মুবিনের মনে হল, মেয়েটা তার দিকে চেয়ে রয়েছে। মুবিন তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। সাথে সাথে মেয়েটা চোখ নামিয়ে নিল। মুবিন মাত্র কয়েক সেকেণ্ড মেয়েটার চোখে চোখ রেখেছে। তাতেই তার মনে অজানা এক অনুভূতি অনুভব হল। তারপর যে কয়দিন ওয়াহাবকে দেখতে গেছে, সেই কয়দিনই মেয়েটাকে দেখার আগ্রহ জেগেছে। কিন্তু বাড়ির এখানে ওখানে দেখলেও সে যতক্ষণ থেকেছে ততক্ষণ ওয়াহাবের কাছে আসেনি। ওয়াহাব মোটামুটি সুস্থ্য হওয়ার পর শেষ দিন যখন মুবিন তাকে দেখতে গেল তখন সেই মেয়েটি ওয়াহাবকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। সেখানে আর কেউ ছিল না। মুবিনকে দেখে একপাশে। সরে দাঁড়াল।