মজিদ হেসে উঠে বলল, ও তাই বল। আমি মনে করেছিলাম কি না কি হয়েছে।
যেদিন খালেদা ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে গেল, সেদিনও শবনম ভাগনা ভাগনিকে আদর করল না। আপার সঙ্গেও কথা বলল না। শুধু দুলাভাইকে আবার আসতে বলল।
কয়েকদিন পর শবনম সবকিছু জানিয়ে আতাহারকে চিঠি দিল।
আতাহার চিঠির উত্তরে সমবেদনা জানিয়ে লিখল, পরীক্ষা পর্যন্ত এসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করো না। তোমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ আমি আসব এবং যা করার করব। এর মধ্যে আসতে পারব না। তুমি আল্লার উপর ভরসা করে ধৈৰ্য্য সহকারে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দাও। তোমাকে তো বলেছি তকৃদিরে যা আছে, তা কেউই রদ করতে পারবে না। আর তোমার আমার সম্পর্কের ব্যাপার নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো উচ্চবাচ্য করো না।
শবনম চিঠি পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও সম্পুণ হতে পারল না। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল। টেস্ট পরীক্ষায় এলাও হওয়ার পর একদিন মেজভাই নাসির উদ্দিনকে বলল, তুই আমার একটা উপকার করবি?
নাসির উদ্দিন ও শবনম কোলে-পিঠে। তাই দুজনে যেমন তুই তোকারি করে, তেমনি সব সময় খিটির-মিটির লেগেই থাকে। কিন্তু উক্ত ঘটনার পর কেউ কারো সঙ্গে লাগেনি। নাসির উদ্দিনের মনে ভয় ঢুকে গেছে। সে যে আতাহারের বোন কুলসুমকে ভালবেসে ফেলেছে। সে কথা এখনো কেউ জানে না। তবে কুলসুমকে যে সে রোজ বিকেলে পড়াতে যায়, শবনম সে কথা আতাহারের কাছে শুনেছে। তাই এই ঘটনার পর যেদিন শবনম তাকে বলেছিল, তুই যে কুলসুমকে পড়াতে যাস, আম্মা শুনলে তোর সঙ্গেও খুব রাগারাগি করবে। সেদিন নাসির উদ্দিন কোনো কথা না বলে চুপ করেছিল। আতাহারের জন্য আপা ও আম্মা শবনমকে মেরেছিল জেনে তার যেমন মায়া হয়েছিল, তেমনি নিজের কথা ভেবে আরো বেশি ভয় পেয়েছিল। আজ শবনমের উপকার করে দেবার কথা শুনে বলল, বল কি করতে হবে।
আপার ননদের দেবরের ভোলার ঠিকানাটা জোগাড় করে আমাকে দিতে পারিস?
নাসির উদ্দিন শবনমের চেয়ে দুবছরের বড়। স্মরণ শক্তি কম বলে এস.এস.সি পরীক্ষায় দুবার ফেল করে এবছর শবনমের সঙ্গে আবার দিবে। যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়েছে। তার ঠিকানা কেন চাইছে বুঝতে না পেরে বলল, তার ঠিকানা নিয়ে তুই কি করবি?
কি করব এখন বলব না, পরে বলব।
নাসির উদ্দিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি তার ঠিকানা জানি।
সত্যি বলছিস?
হারে সত্যি, আপাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে একবার আমাকে ঠিকানা দিয়ে বলেছিল বেড়াতে যাওয়ার জন্য।
শবনম কাগজ কলম নিয়ে এসে বলল, তা হলে লিখে দে।
নাসির উদ্দিন ঠিকানা লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে তাকে চিঠি দিবি নাকি?
শবনম মৃদু হেসে বলল, বললাম না, এখন কিছু বলব না, পরে বলব? তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কি এখনো কুলসুমকে পড়াতে যাস?
নাসির উদ্দিন মাথা নেড়ে বলল, তুই যেন আম্মাকে বলে দিস না।
শবনমের সঙ্গে কুলসুমের স্কুলে প্রায় দেখা হয়। তার সঙ্গে কথা বলে শবনম বুঝতে পেরেছে, মেজ ভাইয়ের সঙ্গে কুলসুমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে মেজভাই এখনো তাকে পড়াতে যায়। তবু কি বলে জানার জন্য এখন জিজ্ঞেস করেছিল। মেজ ভাইয়ের কথা শুনে হেসে উঠে বলল, তোদের ব্যাপারটা জেনে গেছি। আম্মাকে অনেক আগেই জানাতে পারতাম, কিন্তু জানাইনি। তবে বিশ্বাস রাখিস, এতদিন যখন জানাইনি তখন ভবিষ্যতেও জানাব না।
ছোট বোনের কাছে ধরা পড়ে নাসির উদ্দিন লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
সেইদিন রাত বারোটা পর্যন্ত শবনম পড়াশোনা করল। তারপর বই বন্ধ করে মেজ ভাইয়ের পড়ার শব্দ না পেয়ে বুঝতে পারল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাগানের দিকে কি একটা পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল। দূরে শিয়ালের ডাক শুনতে পেয়ে পাড়ার কুকুরগুলো একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। এমন সময় কয়েকটা পেঁচা এক সঙ্গে ডেকে উঠতে শবনম ভয়ে চমকে উঠল। জানালাটা বন্ধ করে ছোট বোন আসমার দিকে চেয়ে দেখল, সে বেঘোরে গুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে মাঝখানের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, আম্মাও ঘুমাচ্ছে। ঠিকানা পাওয়ার পর ভেবে রেখেছে, সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে। মুবিনকে চিঠি লিখবে। পড়ার টেবিলের কাছে এসে চিঠি লিখতে বসল। কি বলে সম্বোধন করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে শেষে চিন্তা করল, আপার ননদের দেবর যখন, তখন তো বিয়াই বলেই সম্বোধন করা যায়।
বিয়াই,
পত্রে আমার সালাম নেবেন। আশা করি আল্লাহপাকের রহমতে ভাল আছেন। আর তাই কমনাও করি। এবার আমার পরিচয় দিয়ে আসল বক্তব্যে আসছি, আমি হলাম আপনার ভাবির ভাবির বোন। অর্থাৎ আমার বড় আপা হল, আপনার ভাবির ভাবি। আরো ভোলাসা করে বলছি। আপনার ভাবির বড় ভাই আমার আপাকে বিয়ে করেছে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আমি কে? হ্যাঁ আমার সঙ্গেই আপনার বিয়ের কথা হয়েছে। ছোটবেলায় আপনাদের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি। তখনকার কথা মনে নেই। তবে বড় বেলায় আপনার সঙ্গে মাত্র একবার অল্পক্ষণের জন্য আলাপ হয়েছিল। সেই সময়ে যতটুকু আপনাকে জেনেছি এবং আপার মুখে আপনার প্রশংসা শুনে যা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে, আপনি পাত্র হিসেবে রত্ন। আপনার যিনি স্ত্রী হবেন, তিনি যে অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ করার পেছনে আপার অবদান প্রচুর। আব্বা গিয়ে আপনাকে ও আপনাদের সবকিছু দেখেশুনে পছন্দ করে বিয়ের কথাবার্তা একরকম পাকা করে এসেছেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। কারণ আমি আপনার অনুপযুক্ত। আমার তকদিরে আপনার মতো রত্নকে আল্লাহপাক রাখেননি। তা না হলে তিনি কেন ছোটবেলা থেকে আমাদের গ্রামেরই একটা ছেলের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে দিলেন? তার ভেদ তিনিই জানেন। জ্ঞান হওয়ার পর আমরা একে অপরের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সামাজিক দৃষ্টিতে ছেলেটি আমার ও আমাদের পরিবারের অনুপযুক্ত। তাই আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে অভিভাবকেরা আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। অবশ্য আপনার মতো পাত্র পেলে যে কোনো মেয়ের অভিভাবক লুফে নেবে। আমি এই সম্বন্ধ জানতে পেরে প্রতিবাদ করি। ফলে আমার উপর নেমে আসে অভিভাবকদের অত্যাচার। পরীক্ষার জন্য এখন অত্যাচার বন্ধ আছে। মনে হয়, পরীক্ষার পর অত্যাচারের মাত্রা-সীমা ছেড়ে যাবে এবং আমার অমতে আপনার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেবে। তবে আমিও তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি, তোমরা যদি জোর জবরদস্তি কর, তা হলে আমার সঙ্গে নয়, আমার লাশের সঙ্গে বিয়ে হবে। এই পত্র পড়ে আমাকে চরিত্রহীনা মেয়ে ভাবতে পারেন, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি কি, তা আল্লাহপাক জানেন। আর একটা কথা লিখে আমার বক্তব্য শেষ করব। সবকিছু জানার পরও যদি আমাকে বিয়ে করতে চান অথবা না চান, তা হলে আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, এই চিঠির কথা সারা-জীবন গোপন রাখবেন। আশা করি আমার এই অনুরোধটুকু ইনশাআল্লাহ রাখবেন। আর আমার চিঠি পড়ে যদি আপনি মনে কষ্ট পান, তা হলে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দেবেন। আল্লাহপাকের দরবারে আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক, শান্তির হোক, এই কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।