স্বামীর চিঠি পেয়ে যুবাইদা খানম খালেদাকে চিঠি দিয়ে জানালেন, তোর আব্বা সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আসবে। আমি তাকে তোদের ওখানে পাঠাব। যতটা পারিস কথা এগিয়ে রাখবি। শবনমের পরীক্ষার পরপর বিয়ের দিন করার ব্যবস্থা করবি।
.
০৬.
এতদিন রমিসা ও মুনসুর জানে না যে, শাইমা বেগম তার ভাইপোদের নামে তাদের বাস্তুটা রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন। একদিন কুলসুমের সাথে মুরগী নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে রমিসা বলল, তোদের গুষ্ঠীকে ভিটে ছাড়া না করেছি তো আমি বাপের বেটি না। আমার মায়ের জায়গায় কি করে থাকিস দেখব।
কুলসুম এখন বড় হয়েছে। জ্ঞানও বেশ হয়েছে। বলল, আমরাও দেখব কেমন করে ভিটে ছাড়া কর। ফুফু আমাদেরকে এই জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে।
রমিসা শুনে মায়ের উপর ভীষণ রেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে গিয়ে বলল, তুমি নাকি আতাহারদের বাস্তুটা তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছ?
শাইমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, যা দিয়েছি, তাতে তোর কি?
রমিসা আরো রেগে গিয়ে বলল, আপা ও ভাইয়া জানে?
শাইমা বেগম বললেন, আমার অংশ থেকে দিয়েছি, তাদেরকে জানাতে হবে কেন?
রমিসা রাগের সঙ্গেই বলল, কাজটা তুমি ঠিক করনি মা। আমি ও তোমাদের জামাই এখানে রয়েছি, আমাদেরকে অন্তত জানান উচিত ছিল। যারা আমাদেরকে একদম দেখতে পারে না, তাদেরকে দেওয়া ঠিক হয়নি।
শাইমা বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোর অংশ তোকে দিয়েছি। আর তোর বড় বোনের অংশ রেখে এতিম ভাইপোদেরকে দিয়েছি। এতে আবার উচিত অনুচিত হল কোথায়?
রমিসা বলল, তোমার জামাই বলছিল, আমাদের ঐটুকু জায়গায় গোজরান করা খুব কষ্টকর। তাই ঐ জায়গাটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার কথা তোমাকে বলব, ভেবেছিলাম।
শাইমা বেগম এবার রেগে গিয়ে বললেন, যতটুকু দিয়েছি, তাতেই কষ্ট করে। পারলে থাকবি, নচেৎ অন্য কোথাও বেশি জায়গা-জমি কিনে জামাইকে বাস্তু বানাতে বলবি।
রমিসা কেঁদে ফেলে বলল, তুমি নিজেই তো দেখে শুনে জামাই করেছ। এখন আবার এই কথা বলছ কেন? তোমার জামাইয়ের যদি সে রকম ক্ষমতা থাকত, তা হলে তোমার জায়গার আশা করতাম না। মেয়ে জামাইয়ের ভালোমন্দ দেখে না, এমন মা যে দুনিয়াতে আছে তা জানতাম না।
শাইমা বেগম বললেন, তোর কি জ্ঞানগম্য বলতে কিছুই নেই? তোকে তো তোর প্রাপ্য দিয়েছি। তবু তোর আশা মিটেনি। এতিম মামাতো ভাইবোনদের পথে বসিয়ে ঐ জমিটাও পেতে চাস। তোদের মতো অমানুষ আছে বলে আমিও জানতাম না। যা আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। তোকে পেটে ধরেছি ভাবতে নিজের কাছে ঘেন্না লাগছে।
রমিসা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মামী তোমাকে তাবিজ করেছে। তা না হলে নিজের মেয়ে জামাই নাতি নাতনিদের চেয়ে ভাবি ও ভাইপো-ভাইজীরা তোমার আপন হল।
শাইমা বেগম আরো রেগে গিয়ে বললেন, তোর মধ্যে যদি এতটুকু মনুষ্যত্ব বোধ থাকত, হা হলে এসব কথা বলতিস না। তোর আর কোন কথা শুনতে চাই না। চলে যা এখান থেকে।
রমিসা যেতে যেতে বলল, বেঁচে থাকতে আর কোনোদিন তোমার কাছে আসব না।
শাইমা বেগম বললেন, তোর মতো মেয়ের মুখ আমিও দেখতে চাই না।
সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীর চিঠির উত্তর দেওয়ার পর বড় ছেলে সামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বললেন, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি বাড়ি যাব। তুমি অনেক দিন যাওনি। আমার ইচ্ছা-আমার সঙ্গে তুমিও যাবে। সেই মতো ছুটি নিও।
সামসুদ্দিন বলল, ঠিক আছে আব্বা তাই হবে।
পরের মাসে সাখাওয়াত হোসেন ও সামসুদ্দিন বাড়িতে এল।
যুবাইদা খানম এক সময় সামসুদ্দিনের সামনে স্বামীকে শবনম ও আতাহারের সম্পর্কের কথা বলে খালেদার ননদের কথাও বললেন।
সামসুদ্দিন শুনে খুব রেগে গেলেও আব্বার আগে কিছু বলা বেয়াদবি হবে ভেবে চুপ করে রইল।
সাখাওয়াত হোসেন আতাহারকে ছোট বেলা থেকেই খুব ভালবাসতেন। শবনমের সঙ্গে যখন খেলাধুলা করতে দেখতেন, সেই সময় তাদের দুজনের মিল দেখে মনে মনে ভেবে ছিলেন, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে আতাহারের সাথে শবনমের বিয়ে দেবেন। পরে যখন আতাহারের আব্বা মারা গেলেন এবং আতাহার লেখাপড়া বন্ধ করে ঢাকায় চাকরি করছে শুনলেন তখন সেই ইচ্ছাটা বাতিল করে দেন। এখন স্ত্রীর মুখে তাদের সম্পর্কের কথা শুনে গম্ভীর মুখে বললেন, আতাহারের আব্বা খুব ভালো লোক ছিলেন। ওদের বংশটাও খুব ভালো। আতাহার খুব ভাল ছাত্র ছিল; কিন্তু তার আব্বা হঠাৎ মারা যাওয়ায় পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তিনিও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
সামসুদ্দিন আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে সংযত কণ্ঠে বলল, তাই বলে আমরা তো শবনমকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারি না। এ বছর শবনম এস.এস.সি পরীক্ষা। দেবে। আতাহার তো টেনে উঠে আর পড়েনি। তাদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। তা ছাড়া যেখানে আপার ননদ তার দেবরের জন্য শবনমকে পছন্দ করেছে, সেখানে। আতাহারের কথা চিন্তা করাই যায় না। আমি আপাদের বাড়ি গিয়েছি। তখন একবার তার ননদের স্বামী আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অবস্থা খুব ভালো। ছেলে শিক্ষিত ও চাকরি করে। এত ভালো সম্বন্ধ আমরা হাতছাড়া করতে পারি না।
সাখাওয়াত হোসেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যা তোমার কথাই ঠিক। খালেদা যখন এটা চাচ্ছে তখন আমাদের এই পাত্র হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না। তবে সবকিছুর আগে ছেলেকে ও তাদের সবকিছু দেখতে হবে। ছেলে শিক্ষিত ও চাকুরে হলেই যে ভালো হবে, তা ঠিক নয়। তার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে। ছেলে ও তাদের বাড়ির সবাই ধর্ম-কর্ম করে কিনা, ছেলের বাবা, দাদা নানা সুদ খায় কি না সবকিছু জানতে হবে। তা ছাড়া ছেলের আগে কোনো বিয়ে হয়েছে কিনা? হয়ে থাকলে সে স্ত্রীর খোঁজও নিতে হবে। আজকাল মেয়ের বাবারা এইসব না দেখে না শুনে রোজগারী ছেলে ও ভালো অবস্থা দেখে জামাই করছে। তার ফলে বিয়ের পর মেয়েকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে।