আতাহারের পরের বোন কুলসুম সেভেনে পড়ে। তাকে নাসির উদ্দিনের খুব পছন্দ। ভেবে রেখেছে, ভবিষ্যতে তাকে বিয়ে করবে। সেই জন্যে আতাহার ঢাকা থেকে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করার অসিলায় মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যায়। তার সঙ্গে স্কুলের যাতায়াতের পথে দেখা করে।
কুলসুম এখন কিশোরী হলে কি হবে, খুব চালাক চতুর মেয়ে। নাসির উদ্দিন যে ভাইয়ার বন্ধু তা জানে। ভাইয়ার সঙ্গে অনেকবার তাদের বাড়ি এসেছে। মাও যে তাকে বেশ স্নেহ করে তাও জানে। তাই তার কিশোরী মনে নাসির উদ্দিনকে ভালো লাগে। সে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেলেও খুশি হয়। কুলসুম অংকে ও ইংরেজিতে কাঁচা। তাই মাকে ও ভাইয়াকে একদিন বলেছিল, প্রাইভেট মাস্টার রাখার কথা।
আতাহার কিছু বলার আগে রফিকা বেগম বলেছিলেন, নিজে কষ্ট করে পড় মা। দেখছিস না, তোর ভাইয়া নিজে পড়াশোনা বন্ধ করে কত কষ্ট করে তোদেরকে লেখাপড়া করাচ্ছে।
আতাহার তখন কিছু না বললেও সেইদিন নাসির উদ্দিনকে সময় করে কুলসুমের অংক, ইংরেজিটা একটু বুঝিয়ে দিতে বলেছিল।
নাসির উদ্দিন সানন্দে রাজি হয়ে যায় এবং তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে কুলসুমের বাড়ি গিয়ে তাকে অংক, ইংরেজি বুঝিয়ে দেয়। তার ছোট বোন খাদিজাকেও পড়ায়।
একথা তাদের বাড়ির কেউ জানে না। এখন মায়ের কথা শুনে ভাবল তা হলে কি আতাহার ও শবনমের মধ্যে ভালবাসা হয়েছে। নিজের কথা ভেবে আতাহারের উপর রাগতে গিয়েও পারল না। কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল। যুবাইদা খানম তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরো রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গেই বললেন, কিরে কিছু বলছিস না কেন?
নাসির উদ্দিন বলল, আমাকে বকছ কেন? শবনমকে নিষেধ করে দাও। ওতো সেই ছোটবেলা থেকেই আতাহারের সঙ্গে মিশে। আগে থেকে নিষেধ করলে এরকম হত না।
নিষেধ আমি আগে থেকেই করছি। তুই আতাহারকে ঘরে নিয়ে এসে ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিস। আর কোনোদিন আনবি না। ওর সঙ্গে তুইও মেলামেশা করবি না। এবারে খালেদা এসে বলে গেল, তার বড় ননদ দেবরের জন্য শবনমকে পছন্দ করেছে। কত বড়লোক তারা। ছেলে এম, এ পাশ। ভোলাতে ব্যাংকে চাকরি করে। এসব ব্যাপার জেনে গেলে তারা কি আর সম্বন্ধ করবে?
এসব কথা আমাকে বলছ কেন? তোমার মেয়েকে বল।
মেয়েকে বললে যদি শুনতো, তা হলে আতাহারের সঙ্গে মিশত না। তোদের আব্বাকে কালকেই চিঠি দেব। যার মেয়ে সেই এসে যা করার করবে। তারপর গজর গজর করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
এবারে খালেদা এসে যখন শবনমকে তার ননদের ইচ্ছার কথা বলছিল তখন থেকে শবনম খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। গতকাল চৌধুরীদের বাগানে আতাহারকে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আতাহারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে কথা ভুলে গেছে। আজ বলবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু আসমার জন্য টেনসনে ছিল বলে বলতে পারেনি। এখন মেজভাইকে আম্মা যেসব কথা বলল, সব শুনে শবনমের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। ভেবে রাখল, কাল আতাহার ভাইকে কথাগুলো বলতেই হবে।
পরের দিন আতাহার দুপুর একটার সময় শবনমদের স্কুলের গেটের বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগল।
টিফিনের ঘন্টা পড়ার দুতিন মিনিট পর শবনম গেটের বাইরে এসে আতাহারকে দেখে সালাম দিল।
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে বলল, কি ব্যাপার, চাচি-আম্মা বকেছে নাকি? তোমার মনটা ভার ভার মনে হচ্ছে?
শবনম বলল, আম্মা তোমার আমার সম্পর্কের কথা এবং তুমি বাড়ি এলেই তোমার সঙ্গে যে চৌধুরীদের বাগানে দেখা করি, সে সব জানতে পেরেছে। গতরাতে আমাকে খুব বকাবকি করেছে। আর একটা কথা, আপার ননদ তার দেবরের জন্য আমাকে পছন্দ করেছে। আম্মা, আব্বাকে বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিয়েছে। তুমি ঢাকা চলে যাওয়ার পর যদি আব্বা বাড়ি এসে বিয়ের কথাবর্তা ঠিক করে ফেলে, তা হলে কি হবে?
আতাহার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এতে দুঃশ্চিন্তার কি আছে? আল্লাহ আমাদের জোড়া যদি তৈরি করে থাকেন, তা হলে যতই বিয়ের কথাবার্তা হোক বা অন্য কিছু হোক না কেন সব ভেস্তে যাবে। তুমি সবর করে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চাও। আমিও চাইব। তারপর তকৃদিরে যা আছে তা তো হবেই। আমি চারদিনের ছুটিতে এসেছি। কাল চলে যাব। তোমার আব্বা আসার পর কি হল না হল, চিঠি দিয়ে জানাবে। তারপর কি করব না করব আমিও তোমাকে চিঠি দিয়ে জানাব। নচেৎ এসে যা করার ভেবে চিন্তে করব। তোমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি বিয়েতে মত দিও না।
শবনম ছলছল চোখে বলল, আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। আমার চিঠি যদি তুমি সময় মত না পাও?
আতাহার বলল, এতদিন যখন সময় মত পেয়েছি, তখন ইনশাআল্লাহ এবারও পাব। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আল্লাহর উপর সব সময় ভরসা রাখবে। আর নিজের মনের। বাসনা তাকে জানাবে। টিফিন ওভারের ওয়ার্নিং ঘন্টা শুনে বলল, এখন আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে ফিরে চলল।
শবনম আতাহারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিল। ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও একইভাবে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তারপর ঘন্টা পড়ার শব্দ শুনে চোখ মুছে ক্লাসে গেল।
স্ত্রীর চিঠি পেয়েও সাখাওয়াত হোসেন অফিসের কাজের চাপে আসতে পারলেন না। চিঠির উত্তরে সে কথা জানিয়ে লিখলেন, শবনমকে এ ব্যাপারে এখন বেশি রাগারাগি করার দরকার নেই। ওর সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার পর সামসুদ্দিনের ও ওর একসঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করব। আল্লাহপাক রাজি থাকলে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আসব।