আসমা বলল, তোমাকে রেখে কাল চলে গেছি বলে আম্মা বকাবকি করে বলল, তোমার দেরি হলেও অপেক্ষা করতে।
শবনম ভাবল, আম্মা কি কিছু টের পেয়েছে? কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, আয়।
কিছু দূর আসার পর অন্য রাস্তায় যেতে দেখে আসমা বলল, এদিকে যাচ্ছ কেন? শবনম সে কথার জওয়াব না দিয়ে বলল, তুই চৌধুরীদের বাগানে কখনো গেছিস?
না। ওখানে নাকি জ্বীনেরা থাকে। আম্মা সে কথা বলে ওখানে যেতে নিষেধ করেছে।
আম্মা ঠিক কথাই বলেছে, তবে এখন আর সেখানে জ্বীনেরা থাকে না। চৌধুরী হুজুর সেখানে বাড়ি করেছেন। এখন সেখানে লোকজন বাস করে।
সত্যি বলছ মেজ আপা?
হারে সত্যি। চল আজ তোকে তাদের কাছে নিয়ে যাব। তা হলেই বুঝবি আমি সত্যি বলছি না মিথ্যে বলছি।
শবনম তাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আলমাসদের বাড়িতে এল।
আলমাস তখন বাড়ির সামনে যেখানে লালশাক চাষ করেছিল, সেখানে দাউলি দিয়ে নিড়ানী দিচ্ছিল। ওদেরকে দেখতে পেয়ে দাউলি হাতে করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি মা, আজ আতাহার বাবাজী কোথায়? তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ আবার কাকে সাথে করে এনেছ?
শবনম সালাম দিয়ে বলল, এ আমার ছোট বোন আসমা। ওতো ভয়ে আসতেই চায় না। বলে, এখানে জ্বীনেরা থাকে।
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে হেসে উঠে আসমার দিকে চেয়ে বলল, জান মা আগে হয়তো এখানে জ্বীন থাকত, এখন আর নেই।
জয়তুন এতক্ষণ ঘরের ভিতর ছিল। স্বামীর সঙ্গে কারা যেন কথা বলছে শুনে বেরিয়ে এল।
তাকে দেখে শবনম বলল, চাচি আমার বোন আসমা আপনাদেরকে দেখতে এসেছে। আপনারা এর সঙ্গে কথা বলুন, আমি একটু আসছি। তারপর ফিরে চলল।
আসমার জ্বীনের ভয় এখনও কাটেনি। ভয়ার্তকণ্ঠে বলল,এই আপা, তুমি আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছ?
শবনম এগিয়ে এসে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, কিরে ভয় পাচ্ছিস কেন? এনারা তো জ্বীন নয়, আমাদের মত মানুষ।
এমন সময় পাঁচ বছরের ও দুবছরের দুটো ছেলে-মেয়ে এসে জয়তুনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা খিদে পেয়েছে, মুড়ি খাব।
জয়তুন বলল, দাঁড়া দিচ্ছি। তারপর আসমা ও শবনমের দিকে চেয়ে বলল, এস মা, তোমাদেরকেও কিছু খেতে দেই।
শবনম বলল, আমি খাব না, আসমাকে দিন। তারপর আসমাকে বলল, তুই নাস্তা খা। বাগানের ওপাশে আমার এক বান্ধবীর বাড়ি। তার সঙ্গে দেখা করে এক্ষুণি ফিরব। তারপর সে চলে গেল।
আসমার তবুও ভয় কাটল না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
জয়তুন তাহার হাত ধরে এনে দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে বসতে দিল। তারপর মুড়ি ও নারকেলের নাড় খেতে দিয়ে বলল, খাও মা। তোমার আপা তো আতাহারের সঙ্গে প্রায়ই এখানে আসে।
আসমা বুঝতে পারল, মেজ আপার কেন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়।
আতাহার আগে থেকে বাগানের রাস্তার ধারে একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। শবনমের সঙ্গে আসমাকে আসতে দেখে আড়াল হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাদেরকে আলমাসদের ঘরের দিকে যেতে দেখে তাদের পিছু নিয়ে আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। শবনম কাছাকাছি এলে তার সামনে এসে সালাম দিয়ে বলল,কি ব্যাপার। আজ আসমাকে এনেছ কেন?
শবনম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার ফিরতে দেরি দেখে আম্মা এতদিন বকাবকি করেছে। এবার মনে হয় সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তারপর আসমাকে আনার কারণ বলে বলল, আজ দেরি করতে পারব না। কাল থেকে এখানে আসতেও বোধ হয় আর পারব না। তুমি কাল টিফিনের সময় স্কুলের বাইরে থেক, খুব জরুরী কথা আছে বলব। এখন আসমাকে নিয়ে বাড়ি যাই।
আতাহার বলল, ঠিক আছে যাও। ইনশাআল্লাহ কাল দেখা হবে। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।
শবনম আসমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
ঐদিন দেরিতে ফিরতে দেখেও যুবাইদা খানম তখন কাউকে কিছু বললেন না। এশার নামায পড়ে যুবাইদা খানম পাশের রুম থেকে আসমা বলে ডাক দিলেন।
আসমা ও শবনম তখন পড়ছিল। মায়ের ডাক শুনে জ্বি আম্মা আসছি বলে আসমা মায়ের কাছে এল।
যুবাইদা খানম তাকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আজও তোদের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হল যে?
আসমা খুব সহজ সরল মেয়ে। বলল, জান আম্মা, চৌধুরীদের বাগানে এখন আর জ্বীন থাকে না। সেখানে ঘর উঠিয়ে লোকজন বাস করছে। আপা আজ আমাকে তাদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারা নারকেলের নাড়ু ও মুড়ি খেতে দিল। তাদের মুখে শুনলাম, আতাহার ভাই ও মেজ আপা প্রায় ওখানে যায়।
যুবাইদা খানম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, চৌধুরীদের বাগানের কথা আমি জানি। আর কখনো ওখানে যাবি না। আজও আতাহার গিয়েছিল?
আমি দেখিনি। আমি যখন নাস্তা খাচ্ছিলাম তখন আপা কোথায় যেন গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে ঘরে এল। যুবাইদা খানম যা জানার জেনে গেলেন। বললেন, যা এবার পড়তে যা।
আসমাকে ডাকতে শবনম ভাবল, আম্মা নিশ্চয় ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। তাই উৎকণ্ঠিত হয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আসমা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করল, কিরে তোকে আম্মা ডাকল কেন?
আসমা বলল, আম্মা আমাদের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হল কেন জিজ্ঞেস করল।
তুই কি বললি?
বললাম,তুমি চৌধুরীদের বাগানে যারা থাকে তাদের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলে।
আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
আতাহার ভাই সেখানে ছিল কি না জিজ্ঞেস করেছিল। আমি বললাম তাকে দেখিনি।
যুবাইদা খানম মেয়েকে শাসন করার জন্য আসমার পিছনে পিছনে এসে শবনম তাকে কিছু বলছে শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আসমার কথা শেষ হতে ভিতরে এসে রাগের সঙ্গে শবনমকে বললেন, তোকে আতাহারের সঙ্গে মিশতে কতবার নিষেধ করেছি, তবুও তুই তার সঙ্গে মিশিস কেন? তোর কী বদনামের ভয় ডর নেই? তোর আব্বা বাড়ি আসুক, তারপর কি করি দেখিস। আর কোনোদিন ওর সাথে মিশবি না। যদি শুনি আবার তার সঙ্গে চেীধুরীদের বাগানে গেছিস, সেদিন তোর একদিন কি আমার একদিন। তারপর নাসির উদ্দিনের রুমে গিয়ে তাকে বললেন, আতাহারের সঙ্গে তোর তো খুব বন্ধুত্ব। সে দেশে এলে তাকে ঘরে নিয়ে আসিস। তার সঙ্গে যে তোর বোন। চৌধুরীদের বাগানে যায়, সে খবর রাখিস?