শবনম চোখের পানি রোধ করতে পারল না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, এই দোয়া আমি সব সময় করি। আব্বা-আম্মার মুখে শুনেছি, ঈমানদার বান্দা-বান্দীর দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আমার পূর্ণ একিন আছে, আল্লাহ আমাদেরকে নিরাশ করবেন না। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আতাহারের দুটো হাত নিজের গালে চেপে ধরে বলল, আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। তিনি তোমাকে হেফাজত করবেন এবং কামিয়াব করবেন।
আতাহার বলল, আমিও তোমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। তিনি তোমাকেও কামিয়াব করবেন।
শবনম আমিন বলে বলল, চল এবার ফেরা যাক।
আতাহার ও শবনম এই কদিন চৌধুরীদের বাগানে প্রতিদিন এলেও সময়ের অভাবে মাত্র আর একদিন আলমাস ও তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে।
আলমাস প্রথম দিন তাদেরকে খাতির যত্ম করলেও দুজনের সম্পর্কের কথা বুঝতে পারেনি। তারা চলে যাবার পর স্ত্রীর কাছে শুনেছে, ওরা একে অপরকে ভালবাসে। কিন্তু। আজ আড়াল থেকে তাদের সবকিছু দেখে শুনে জানতে পারল ওরা একে অপরকে কি দারুন ভালবাসে। হঠাৎ চৌধুরী হুজুরের কথা মনে পড়তে ভাবল, উনি বুঝি ব্যাপারটা জানেন এবং ওদেরকে খুব স্নেহ করেন। তাই খাতির যত্ন করতে বলেছেন। ওদেরকে চলে যেতে দেখে এগিয়ে এসে বলল, আমাদের সঙ্গে দেখা না করে চলে যাচ্ছ যে?
আতাহার সালাম দিয়ে বলল, আজ আমাদের মন ভালো নেই চাচা। তাই ভুলে গেছি। চলুন চাচির সঙ্গে দেখা করে আসি।
দেরি হয়ে যাবার আপত্তি সত্ত্বেও আলমাস ও জয়তুন শুনল না। তারা নাস্তা বানিয়ে খাইয়ে তবে বিদায় দিল। বিদায় দেওয়ার সময় আলমাস আতাহারকে বলল, ঢাকা থেকে এলে কিন্তু মা শবনমকে নিয়ে আসবে।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে আতাহার শবনমকে বলল, তুমি যাও, আমি বাজার হয়ে ঘুরে যাব।
শবনম সালাম জানিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর চোখের পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল।
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে তার চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। একসময় তার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ল। শবনম চোখের আড়াল হয়ে যেতে চোখ মুছে বাজারের পথ ধরল।
পরের দিন আতাহার দশটার সময় খাওয়া দাওয়া করে ভারাক্রান্ত মনে ঢাকায় রওয়ানা দিল।
২. এস. এস. সি. পরীক্ষা
০৫.
এ বছর শবনম ও তার মেজ ভাই নাসির উদ্দিন এস, এস, সি পরীক্ষা দিবে। গত বছর নাসির উদ্দিন পরীক্ষা দিয়েছিল কিন্তু পাশ করতে পারেনি। তাই এ বছর আবার দিবে। এই দুবছরের মধ্যে শবনমের ও আতাহারের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতম হয়েছে। শবনম যেমন স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী হয়েছে তেমনি রূপের জৌলুসও বেড়েছে। ক্লাস টেনে উঠার পর থেকে বোরখা পরে স্কুলে যাচ্ছে।
আতাহারও স্বাস্থ্যবান যুবক হয়ে উঠেছে। ছোটবেলা থেকে তার লম্বা চওড়া স্বাস্থ্য। যৌবন প্রাপ্ত হয়ে আরো লম্বা চওড়া হয়েছে। এমনি তার গায়ের রং খুব ফর্সা এখন সেই রং আরো উজ্জ্বল হয়েছে।
আতাহার মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে যে কদিন থাকে, সেই কদিন মেয়ের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হয় দেখে যুবাইদা খানমের মনে সন্দেহ হয়েছে। আরো একটা কারণে তাঁর সন্দেহ জেগেছে, আতাহার বাড়িতে এসেই একবার হলেও তাদের ঘরে আসে। আর তখন থেকেই মেয়ের মুখে আনন্দের আভা দেখতে পান। কয়েকদিন পর সেই আনন্দের আভা থাকে না। মাঝে মাঝে তাকে মন খারাপ করে বই খুলে বসে থাকতে দেখেন। ছেলেমেয়েরা সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও মাকে পারে না। সব। মায়েরাই ছেলেমেয়েদের মনের খবর বুঝতে পারেন। যুবাইদা খানম মেয়ে সেয়ানা হওয়ার পর তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে সন্দেহ করেন; শবনম নিশ্চয় আতাহারকে ভালবাসে। তিনি ভাবেন, ছেলে হিসাবে আতাহার খুব ভালো, তাদের বংশও খুব ভালো। কিন্তু সে শবনমের অনুপযুক্ত। আতাহার ক্লাস টেনে ওঠে আর্থিক দূরবস্থার কারণে লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে। একটা বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আরেকটা বোন চার পাঁচ বছর পর উপযুক্ত হবে। সামান্য চাকরির টাকায় তাদের সংসারের অভাব মেটে না। কিভাবে বোনদের বিয়ে দেবে? এই সব চিন্তা করে ও মেয়ের হাবভাব লক্ষ্য করে তিনি শঙ্কিত হলেন। এবারে আতাহার ঢাকা থেকে এসে যখন তাদের ঘরে এল তখন মেয়ের মুখে সেই একই রকম আনন্দের আভা দেখলেন এবং তার পরের দিন স্কুল থেকেও ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে দৃঢ় বিশ্বাস হল; স্কুল ছুটির পর শবনম ফেরার পথে নিশ্চয় আতাহারের সঙ্গে কোনো জায়গায় যায়। তাই দেরি হয়। শবনমের ছোটবোন আসমা এ বছর সিক্সে পড়ছে। তাকে আজ একা স্কুল থেকে ফিরতে দেখে যুবাইদা খানম জিজ্ঞেস করলেন, তারা দুবোন তো প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাতায়াত করিস। আজ তুই একা এলি যে? তোকে না বলেছি, তোর আগে ছুটি হলেও শবনমের জন্য অপেক্ষা করবি?
আসমা বলল, আমার ছুটি হয়ে যাওয়ার পর আমি অপক্ষো করছিলাম। মেজ আপা এসে বলল, তুই বাড়ি চলে যা, আমার ফিরতে দেরি হবে। তাই চলে এলাম।
যুবাইদা খানম বললেন, কাল যদি তোকে চলে আসতে বলে, তা হলে বলবি, আম্মা থাকতে বলেছে।
পরের দিন স্কুল ছুটির পর আসমা ক্লাসে বসে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় শবনম এসে বলল, তোকে থাকতে হবে না। তুই চলে যা। আমার আজও ফিরতে দেরি হবে।