জয়তুন বলল, হুজুরের গ্রামেই আমাদের বাড়ি। ইউসুফের আব্বা ও আমি হুজুরের বাড়িতে কাজ কাম করতাম। এখানে বাড়ি করার পর হুজুর আমাদেরকে এখানে এনে রেখেছেন। তোমরা কোন গ্রামের ছেলেমেয়ে?
এবার শবনম বলল, আমাদের বাড়ি এই গ্রামেই।
তোমরা দুজন কি ভাইবোন?
শবনম কি বলবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।
আতাহার বলল, হা; তবে চাচাতো।
এমন সময় আলমাস বড় বড় দুটো ডাব এনে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, কাটারীটা দাও। জয়তুন কাটারি এনে দিলে আলমাস ডাব কেটে জগে ঢেলে ওদেরকে গ্লাসে করে খেতে বলল। তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, একটা বাসনে করে মুড়ি নিয়ে এস, আমি ডাব ফেড়ে শাস বের করছি।
নাস্তা পানি করতে করতে আসরের নামাযের আযান হয়ে গেল।
আতাহার বলল, এবার আমরা আসি চাচা?
আলমাস বলল, আবার এস।
আতাহার বলল, আসব; তবে কবে আসব তা আল্লাহপাক জানেন।
কেন? তোমরা তো এই গ্রামেরই ছেলেমেয়ে, যখনই মন চাইবে চলে আসবে।
মন চাইলেই কি সব কিছু করা যায় চাচা? আমি ঢাকায় থাকি। এক বছর পর এসেছি। এক সপ্তাহ পর চলে যাব। আল্লাহপাক আবার কবে নিয়ে আসবেন, তা তিনিই জানেন।
আলমাস তার কথার মধ্যে বেদনার সুর শুনতে পেল। বলল, ঢাকা থেকে যখন ফিরবে তখন তো আসবেই। এখন যে কদিন আছ, রোজ আসতে পারবে না?
তাও আল্লাহপাকের মর্জি। তারপর আতাহার শবনমের দিকে চেয়ে বলল, কি পারবে?
শবনম বলল, তুমিই তো এক্ষুণী আল্লাহপাকের মর্জির কথা বললে, তবে তুমি বললে ইনশাআল্লাহ পারব।
আতাহার এবার আলমাসের দিকে চেয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব, কিন্তু রোজ রোজ মেহমানী করতে পারবেন না। আমাদেরকে যেখানে বসে বসে গল্প করতে দেখেছেন, সেখানে আমরা ছোট বেলায় প্রতিদিন খেলাধুলা করেছি। লুকোচুরি খেলেছি। যে কদিন থাকব সে কদিন আল্লাহ রাজি থাকলে হয় তো ঐখানেই আসব। আর চলে যাওয়ার সময় আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাব।
আলমাস বলল, তাই এস বাবা।
আতাহার ও শবনম তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এল। আসার সময় শবনম বলল, আলমাসের এরূপ করার কারণটা এবার বল।
আতাহার তাকে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল এবং তার পরের ঘটনা বলে বলল, উনি খুব বুজুর্গ লোক।
শবনম জিজ্ঞেস করল বুজুর্গ লোক কাকে বলে?
যারা খুব জ্ঞানী, পরহেজগার, মোত্তাকী এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আইন মোতাবেক সব কিছু মেনে চলেন এবং মানুষকেও সেই পথে চালাবার চেষ্টা করেন, তাদেরকে পীর বা বুজুর্গ লোক বলে।
তাই বলো, আমি তো আলমাস চাচার ব্যবহার দেখে এতক্ষণ খুব অবাক হয়েছি। কিন্তু চৌধুরী হুজুর তাকে আমাদের খাতির যত্ন করতে বলেছেন কেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমিও ঠিক পারিনি, তবে শুনেছি পীরদের অনেক কাজ-কাম সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। ওসব কথা এখন থাক, কাল কখন আসবে বল।
প্রতিদিন তো মিথ্যে বলে স্কুল থেকে ছুটি নিতে পারব না। আজ শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে চার পিরিয়ডের পর ছুটি নিয়ে এসেছি। কাল থেকে ছুটির পর আসব।
সেটাই ভাল। ততক্ষণে তারা শবনমদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। আতাহার দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এবার তুমি যাও। ইনশাআল্লাহ কাল আবার দেখা হবে।
এরপরের দিনগুলো আতাহারের ব্যস্ততার মধ্যে স্বপ্নের মতো কেটে গেল। বাস্তুজমিটা ফুফুর কাছ থেকে রেজিস্ট্রি করে নিতে উকিলের কাছে ও কোর্টে ছুটাছুটি করতে হয়েছে। ছুটিও শেষ কাল দশটার দিকে ঢাকা রওয়ানা দিবে। আজ শেষবারের মতো শবনমের সঙ্গে দেখা করবে বলে সময়ের আগে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে অপেক্ষা করতে লাগল।
শেষ পিরিয়ডের শিক্ষক না থাকায় শবনমদের এক পিরিয়ড আগে ছুটি হয়ে গেল। সে পাড়ার মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অন্য রাস্তা হয়ে চৌধুরীদের বাগানে এল। অবশ্য এরকম চালাকি সে বরাবরই করেছে। আসার সময় চিন্তা করেছিল, এত তাড়াতাড়ি কি আতাহার ভাই আসবে? কিন্তু এসে যখন তাকে দেখল তখন মনটা খুশিতে ভরে গেল। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আজ এক পিরিয়ড আগে ছুটি হয়েছে। ভাবলাম, তোমার জন্য পৌনে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আর তুমি কিনা আমার আগে এসে গেছ।
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, আমার মন বলল, তুমি হয়তো আজ তাড়াতাড়ি আসবে। তাই সময়ের আগে চলে এলাম। এস, বস।
শবনম তার সামনে বসে বই-খাতা কোলের উপর রেখে বলল, আর কদিন থাকবে?
আতাহার কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, পরশু অফিস করতে হবে। তাই ইনশাআল্লাহ কাল সকাল দশটার দিকে রওয়ানা দেব ভেবেছি।
আতাহারের কথা শুনে শবনমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। কোনো কথা বলতে পারল না।
তার অবস্থা দেখে আতাহারের চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, কোন দিক দিয়ে যে সাতদিন চলে গেল, বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে যেন, এই কদিনের ঘটনাগুলো স্বপ্ন।
শবনম প্রথমে চাদর দিয়ে নিজের চোখ মুছল, তারপর আতাহারের চোখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, শুনেছি, আনন্দের দিনগুলো নাকি স্বপ্নের মত চলে যায়।
আতাহার তার দুটো হাত ধরে নিজের গালে চেপে ধরে ভিজে গলায় বলল, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন না করেন, আমাদের দুজনকে যেন স্বামী-স্ত্রী রূপে কবুল করেন। কেন কি জানি মনে হচ্ছে, আবার হয়তো তোমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হবে না।