শবনম যেতে যেতে বলল, তুমি আবার চলে যাবে মনে হলে যে শুধু কান্না পাচ্ছে?
আতাহার বলল, আমি ওসব শুনতে চাই না। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও মনে যে কি যন্ত্রনা হয়, তা আল্লাহপাক জানেন। কিন্তু তকদিরের লিখন কি খন্ডাতে পারব? পারব না। তাই সবর করে থাকি। তুমিও থাকবে।
কথা বলতে বলতে তারা তাদের সেই পুরোনো জায়গায় এসে দেখল, সেখানে নানা রকম ঘাস জন্মেছে। আতাহার ঘাস পরিষ্কার করে দুজনের বসার জায়গা করে বসে বলল, তোমার কথাই ঠিক, তোমাকে এতদিন পরে দেখে যতটা আনন্দ পাচ্ছি, কয়েকদিন পরে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছি।
শবনম কোনো কথা না বলে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
তাই দেখে আতাহারের চোখেও পানি এসে গেল। সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, আবার কাঁদছ? একটু আগে না নিষেধ করলাম।
শবনম একটা বড় চাদর গায়ে দিয়ে স্কুলে যায়। চাদরের আঁচলে চোখ মুছে বলল, তোমার চোখেও তো পানি দেখলাম। তুমি ছেলে হয়ে যদি সামলাতে না পার, তবে আমি মেয়ে হয়ে কি করে পারব?
ঠিক আছে, এখন থেকে কেউ আর কাঁদব না। এবার তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট বল।
তোমার চিন্তায় ভালো করে পড়াশুনা করতে পারিনি; তবুও সেকেন্ড হয়েছি।
আলহামদুলিল্লাহ বলে আতাহার বলল, আমি দোয়া করছি সামনের বছর ইনশাআল্লাহ আরো ভাল রেজাল্ট হবে। কি হবে না?
শবনম বলল, তুমি দোয়া করলে ইনশাআল্লাহ হবে। এবার তোমার চাকরির কথা বল।
চাকরিটা ভালো; কিন্তু বেতন মাত্র আটশো টাকা। তবে সামনের মাসে দুশো টাকা বাড়বে। মামা খালাদের বাসায় থাকি বলে পুরো টাকাটা বাঁচে। নচেৎ কিছুই বাঁচাতে পারতাম না। তুমি দোয়া করো, আমার সাহেব খুব ভালো মানুষ। তাকে একটা ভালো চাকরির কথা বলেছি। উনি আশ্বাস দিয়েছেন।
শবনম বলল, আল্লাহ যেন তোমার মকসুদ পূরণ করেন।
আলমাস ঘরের দাওয়ায় বিছানা পেতে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে বদনা নিয়ে ছোট প্রাকৃতিক কাজ সারবে বলে বাগানের ভিতরে গেল। তখন তার কানে এল কাছা-কাছি কারা যেন কথা বলছে। ভাবল, তা হলে কেউ কি সুপারি বা নারিকেল চুরি করতে এসেছে? প্রাকৃতিক কাজ সেরে আস্তে আস্তে যে দিক থেকে কথা বলার শব্দ আসছিল, সেদিকে এগোল। কিছুটা এসে দুজন তরুণ-তরুণীকে মুখোমুখি বসে কথা বলতে দেখে খুব অবাক হল। ভাবল, কে এরা? এই সময় এমন নির্জন জায়গায় বসে কথা বলছে? হঠাৎ চৌধুরী সাহেবের কথা মনে পড়তে কাছে এসে গলা খ্যাকারী দিয়ে বলল, কে তোমরা? এখানে কি করছ? তোমাদের কি ভয় ডর নেই?
আলমাসের কথা শুনে শবনম ভয় পেলেও আতাহার পেল না। সালাম দিয়ে বলল, আমরা এই গ্রামেরই ছেলেমেয়ে। আপনি কে?
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এই বাগানের মালিক চৌধুরী হুজুর আমাকে এখানে রেখেছেন সবকিছু দেখাশুনা করার জন্য।
তার কথা শুনে শবনমের ভয় কেটে গেল। আতাহারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে এই বাগানের মালিকের বাড়ি তৈরীর কথা বলল।
শবনমের কথা শুনে আতাহার আলমাসকে জিজ্ঞেস করল, চৌধুরী হুজুর কি এখানে আছেন?
আলমাস ভাবল, এদের কথাই হয়তো চৌধুরী হুজুর বলে গেছেন। বলল, না উনি নেই। তারপর তাদের নাম জিজ্ঞেস করল?
আতাহার নিজের ও শবনমের নাম বলল।
আলমাসের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমরা আমার সঙ্গে এস।
আতাহার বলল, কেন?
সে কথা পরে বলব, আগে এসতো আমার সঙ্গে।
আতাহার শবনমকে বলল, চলল চৌধুরী হুজুরের বাড়ি দেখে আসি।
শবনম এটাই চাচ্ছিল। তাই কোন প্রতিবাদ না করে তাদের সাথে যেতে লাগল।
আলমাস তাদেরকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, চৌধুরী হুজুর মাস দুয়েক আগে বাড়ি তৈরী হয়ে যাওয়ার পর একদিন এসেছিলেন। যাওয়ার সময় আমাকে তোমাদের নাম বলে বললেন, তোমরা এলে তোমাদেরকে যেন খাতির যত্ন করি।
আতাহার জিজ্ঞেস করল, উনি আবার কবে আসবেন?
তা বলতে পারব না। হুজুরের যখন মর্জি হবে তখন আসবেন। ততক্ষণে তারা। বাড়ির কাছে এসে গেছে। আলমাস স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই বলল, কইগো ইউসুফের মা, একটা পাটি এনে দাওয়ায় বিছিয়ে দাও; মেহমান এসেছে।
আলমাসের স্ত্রী জয়তুন ঘরের ভিতর ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছিল। একটু আগে জেগেছে। স্বামীর কথা শুনে মনে করল, তাদের কোনো আত্মীয় হয়তো এসেছে। তাড়াতাড়ি করে উঠে ভালো করে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে একটা খেজুর চাটাই নিয়ে বেরিয়ে এসে আতাহার ও শবনমকে দেখে অবাক হল। তারপর চাটাই বিছিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, এরা কারা?
সে কথা পরে বলব, আগে জগে করে পানি এনে দাও এরা হাত মুখ ধুয়ে নিক। খুব গরম পড়েছে, এদেরকে পাখা দিয়ে বাতাস কর। আমি ডাব পেড়ে নিয়ে আসি। তারপর ওদের দুজনের দিকে চেয়ে বলল, তোমরা মুখহাত ধুয়ে বস, আমি ডাব পেড়ে এক্ষুণী আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল।
শবনম খুব অবাক হয়ে আতাহারের দিকে চেয়ে বলল, কি ব্যাপার বলতো?
আতাহার মৃদু হেসে বলল, পরে সব বলব, এখন বসি এস।
একটু পরে জয়তুন জগে করে পানি এনে বলল, তোমরা মুখ হাত ধুয়ে নাও।
ওরা হাতমুখ ধুয়ে বসার পর জয়তুন হাত পাখা দিয়ে তাদেরকে বাতাস করতে লাগল।
আতাহার তার হাত থেকে পাখাটা নিয়ে বলল, আপনাকে বাতাস করতে হবে না। তারপর জিজ্ঞেস করল, চাচী, আপনাদের গ্রামের নাম কি।