জোবেদাও রাগের সাথে বলল, তোকে আর দালালী করতে হবে না। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাই না। তুই এই মুহূর্তে চলে যা। এই কথা বলে সে নিজেই সেখান থেকে চলে গেল।
ফাহমিদা রাগে ও অপমানে ফুলতে ফুলতে বাড়ি চলে গেল।
এদিকে শামী বাড়িতে এসে সেই যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল, শুধু নামায পড়ার সময় ছাড়া সারাদিন আর উঠল না। খাওয়া-দাওয়াও করল না।
তার মা মাসুমা বিবি ছেলেকে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে দেখে কয়েকবার এসে জিজ্ঞেস করেও একটা কথা বলাতে পারেন নি। কিছু খাওয়াতেও পারেন নি। এভাবে দুদিন কেটে যাওয়ার পর মাসুমা বিবি ছোট দেওরের ছেলে জাহিদকে বললেন, তোর ভাইয়ার বন্ধু রায়হানকে ডেকে নিয়ে আয়। বলবি আমি ডেকেছি।
জাহেদের বয়স দশ এগার। ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে রায়হানকে চিনে। তাদের বাড়িতে গিয়ে তাকে সালাম দিয়ে বলল, চাচি আম্মা আপনাকে আমার সাথে যেতে বলেছে।
রায়হান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেন ডেকেছে বলতে পার? তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো তো?
জাহেদ বলল, সবাই ভালো আছে। তবে শামী ভাই আজ তিন দিন বিছানা ছেড়ে উঠে নাই। কিছু খায়ও না। শুধু শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। চাচি আম্মা কত করে জিজ্ঞেস করেছে, কি হয়েছে বল। শামী ভাই কোনো কথাই বলছে না।
রায়হান বুঝতে পারল, নিশ্চয় ফাহমিদা তার ভালবাসা ফিরিয়ে দিয়েছে। বলল, একটু অপেক্ষা কর, আমি হাত পা ধুয়ে গায়ে জামা দিয়ে আসি। সে তখন বাগানে কামলাকে নিয়ে কাজ করছিল। তারপর কামলাকে বলল, তুমি কাজ কর, আমি একটু উত্তর পাড়ায় যাচ্ছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে এসে রায়হান জাহেদকে নিয়ে তাদের বাড়ি রওয়ানা দিল।
বাড়িতে পৌঁছাবার পর জাহেদ তাকে বৈঠকখানায় বসতে বলে ভিতরে গিয়ে চাচি আম্মাকে বলল, ভাইয়ার বন্ধু এসেছে।
মাসুমা বিবি বৈঠকখানায় এলেন।
রায়হান দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আমাকে ডেকেছেন কেন চাচি আম্মা?
মাসুমা বিবি বললেন, গত তিন দিন থেকে শামী শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। কোনো কিছু খাওয়া দাওয়াও করেনি। আমি কত করে বললাম, কি হয়েছে বল। তা যদি একটা রা করল। তুমি ওকে জিজ্ঞেস করত বাবা, কি জন্যে সে এরকম করছে। তোমার চাচাও বাড়িতে নেই। কি যে করব, কিছু ভেবে ঠিক করতে পারছি না।
রায়হান বলল, আমাকে আরো আগে খবর দিলেন না কেন? ঠিক আছে, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সবকিছু ব্যবস্থা করছি। শামী এখন কোথায়?
মাসুমা বিবি বললেন, তিন দিন পর আজ অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নাস্তা খাইয়েছি। তুমি আসবার একটু আগে বেরিয়ে গেল। বোধ হয় আম বাগানে গেছে। তারপর জাহেদকে বললেন, যাতে বাবা রায়হানকে আম বাগানে নিয়ে যা।
শামীদের একটা বড় আম বাগান আছে। সেখানে অনেক পদের আম গাছ। শামীর সঙ্গে রায়হান কতদিন সেই আমবাগানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে গল্প করেছে। মাসুমা বিবির কথা শুনে বলল, জাহেদকে যেতে হবে না, আমি একাই তার কাছে যাচ্ছি। তারপর সে যেতে উদ্যত হল।
মাসুমা বিবি বললেন, একটু বস, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে তারপর যেও।
রায়হান যেতে যেতে বলল, মাফ করবেন চাচি আম্মা, আমি কিছুক্ষণ আগে চা নাস্তা খেয়েছি। আগে শামীর সঙ্গে দেখা করি, তারপর না হয় খাব।
রায়হান আম বাগানে এসে দেখল, শামী একটা আম গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আর তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এই দুতিন দিনে তার চেহারা শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটো কোঠরে ঢুকে গেছে। কাছে এসে সালাম দিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, কিরে, এখানে বসে কাঁদছিস কেন? তোর এরকম অবস্থা হল কি করে?
শামী চমকে উঠে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে রায়হানকে জড়িয়ে ভিজে গলায় বলল, হেরে গেলাম দোস্ত হেরে গেলাম। আমি জীবনে হার কি জিনিস জানি না। কিন্তু ফাহমিদার কাছে হেরে গেলাম। তারপর ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
রায়হান যা বুঝার বুঝে গেল। বলল, তুই শিক্ষিত ছেলে হয়ে একটা মেয়ের কাছে হেরে গিয়ে কাঁদছিস, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এটাকে তুই হার বলছিস কেন? তুই পুরুষ ছেলে। এক ফাহমিদার কাছে হেরে গেছিস তো কি হয়েছে? অমন কত ফাহমিদা তোকে পাওয়ার জন্য হাঁ করে রয়েছে। তোর মতো ছেলে আমাদের গ্রামে আর একটা আছে কিনা সন্দেহ। এখন কান্না থামা। কি হয়েছে বল।
শামী সামলে নিয়ে রায়হানকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুখ মুছল। তারপর সেদিন ফাহমিদার সাথে যেসব কথোপকথন হয়েছিল বলল।
রায়হান অনেক দিন আগেই জানত, ফাহমিদা একদিন না একদিন এরকম কথা বলবেই। তাই এখন শামীর কাছে তার কথা শুনে একফুও অবাক হল না। বলল, তুই এত লেখাপড়া করলি আর এটা জানিস না, মেয়েরা সুখের পায়রা? পায়রা যেমন স্বচ্ছল ও সুখী বাড়িতে বাস করে, মেয়েরাও তেমনি স্বচ্ছল ও সুখী বাড়িতে বাস করতে চায়। সেই বাড়িতে যখন অভাব-অনটন আসে পায়রা তখন অন্য সুখী বাড়িতে চলে যায়। মেয়েরাও সংসারে অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট এলে স্বামী ও স্বামীর বাড়ির সকলের সঙ্গে সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি করে। অনেকে বাপের বাড়ি গিয়ে আর আসতে চায় না। তাই জেনেশুনে কোনো মেয়ে গরিব ছেলেকে বিয়ে করতে চায় না। অবশ্য সব মেয়েরা যে এরকম তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায়। সাহমিদা ঐ ধরনের মেয়ে। আল্লাহ যা করেন সবার ভালোর জন্য করেন। ফাহমিদাকে পেলে তুই সারা জীবন অশান্তি পেতিস। তাই হয়তো আল্লাহ তার মন পরিবর্তন করে দিয়েছেন। যাই হোক, যা হয়েছে ভালই হয়েছে, এবার তাকে তুই ভুলে যা। যে মেয়ে এতদিন তোর সাথে ভালবাসা করে আজ তার খালাত ভাইকে ভালবাসে, সে যে একটা জঘন্য ধরনের মেয়ে তা তুই বুঝতে পারছিস না কেন? তার জন্য আবার কান্নাকাটি করছিস। আমি হলে অমন মেয়েকে মন থেকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দিতাম। খারাপ মেয়ে ভেবে তাকে তোর ভুলে যাওয়া উচিত। সে যদি তোকে ভালবেসেও অন্য ছেলেকে বিয়ে করতে পারে, তবে তুই অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারবি না কেন? তুইও একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে কর।