নাস্তা ও খাওয়া দাওয়ার পর রোকেয়াকে দেখে সকলের পছন্দ হল। শুধু হারুনের মা হানুফা বিবির ও তার এক জায়ের পছন্দ হল না। কিন্তু সকলের পছন্দ হয়েছে জেনে তারা সেখানে কিছু প্রকাশ করলেন না।
হারুনের নানা আনসার উদ্দিনের সব থেকে বেশি পছন্দ হয়েছে। তিনি খুব রসিক লোক। বললেন, রোকেয়ার দীর্ঘ চুল ও ডান চোখের কোনের পাশে যে তিলটা রয়েছে, তাতে করে তাকে খুব সুন্দর লাগছে। তারপর রোকেয়ার হাতে আংটি পরাবার সময় বললেন, এই মেয়েকে দেখিয়ে অন্য মেয়েকে দিলে ঐ দুটো জিনিস দেখে আমরা আসল নকল ধরে ফেলব। তারপর বিয়ের পাকা কথাবার্তা ও দিনক্ষণ ঠিক করে তারা বাড়ি ফিরে গেল।
বাড়িতে এসে হানুফা বিবি বললেন, মেয়ে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। সেই সাথে তার ঐ জাও বলে উঠলেন, আমারও পছন্দ হয়নি।
হারুনের নানা তাদের কথা শুনে বললেন, যখন সবাই পছন্দ করে কথাবার্তা পাকা হল তখন তোমরা কিছু বললে না, এখন আবার এরকম কথা বলছ কেন? তারপর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখ হানুফা, তুই যদি এই মেয়েকে বৌ করে না আনিস, তাহলে আমি আর হারুনের বিয়েতে তো আসবই না, এমনকি সারাজীবনেও। তোদের বাড়িতে আসব না। এরপর হারুনকে বললেন, তুমি যদি রোকেয়াকে বিয়ে না কর, তবে আমিই করে ফেলব।
এই কথা শুনে হারুনু হাসি চাপাতে না পেরে সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় মনে মনে বলল, আল্লাহ পাক, তুমি এই বিয়ে কবুল কর।
পরের দিন হনুফা বিবি রোকেয়াদের বাড়ি পান-চিনি পাঠিয়ে দিলেন।
কয়েকদিন পর শাহেদ আলী খবর পেলেন, পাত্র পক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দেবেন। খবর পেয়ে তিনি খুব মুষড়ে পড়লেন। চিন্তা করলেন, বড় মেয়ে রূপারও একবার বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। আবার মেজ মেয়ের বেলায়ও তাই হবে নাকি? আল্লাহ পাকের কাছে ফরিয়াদ করল, ইয়া আল্লাহ্, তুমি রাহমানুর রাহিম! তুমি আমাদের উপর রহম কর। আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। যা শুনেছি তা যেন মিথ্যে হয়। আমার মান ইজ্জত ধূলোয় মিশিয়ে দিও না।
দুএকদিন পরে শাহেদ আলী জানতে পারল, বাড়ির মধ্যে শুধু হারুনের মা বিয়ে . ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছেন।
এদিকে মা বিয়ে ভেঙ্গে দেবে শুনে হারুন অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরে আসার পর সে মাকে বলল, পাকা কথা হয়ে যাওয়ার পর বিয়ে ভেঙ্গে দিলে গ্রামের লোকজন আমাদের গায়ে থুথু ছিটাবে। তখন আমাদের মান সম্মান থাকবে কোথায়? আমরা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। তাছাড়া নানাজী যেখানে মাথা হয়ে সবকিছু করলেন, সেখানে তুমি যদি বিয়ে ভেঙ্গে দাও, তাহলে তারও মান সম্মান থাকবে না। মুরব্বী মানুষের মান সম্মান তুমি মেয়ে হয়ে নষ্ট করবে? তার চেয়ে এক কাজ কর, বিয়ের কাজ হয়ে যাক। এখন যদি তুমি বৌ আনতে না চাও, তাহলে আমি এখন বিদেশ চলে যাই। আবার যখন আসব তখন না হয় বৌ আনবে।
হানুফা বিবি বললেন, আমি কারো তোয়াক্কা করি না। ঐ মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব না। ওর বাপ গরিব। মেয়ে জামাইকে কিছু দিতে পারবে না। আমি তোর বিয়ে বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে দেব।
হারুন মায়ের উপর রেগে গিয়ে বলল, তুমি গবিবদের এত ঘৃণা কর তা জানতাম না। আমরাও তো গরিব ছিলাম। আজ না হয় তিন ভাই বিদেশে চাকরি করে আল্লাহ পাকের রহমতে কিছু উন্নতি করেছি। তবু বড়লোক তো হতে পারিনি। আর বিদেশ কি আমাদের নানার বাড়ি যে, সেখানে চিরকাল থাকব? মেয়ের বাবার না হয় আমাদের চেয়ে অবস্থা একটু খারাপ। তাই বলে মেয়েটা কি দোষ করল? কেন তুমি তার ফুলের মত জীবনটা নষ্ট করতে চাইছ? আমারো শেষ কথা শুনে রাখ, তুমি যদি এই মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে না দাও, তাহলে সারাজীবন আমি আর বিয়ে করব না এবং বিদেশ থেকে দেশেও ফিরব না।
হানুফা বিবি যেমন মুখরা তেমনি হিংসুটে ও লোভী। তিনটে ছেলে বিদেশে থাকে। মোটা অংকের টাকা পাঠায়। তাই দেমাগে যেন মাটিতে পা পড়ে না। গরিবদের মোটেই দেখতে পারেন না। ছেলেদের বড়লোকের ঘরে বিয়ে দিয়ে অনেক সোনা-দানা, টাকা-পয়সা এবং ঘরের আসবাবপত্র পাবেন, সেই রকম আশা পোষণ করেন। আসলে কিন্তু রোকেয়ার বাবার চেয়ে নিজেরা যে বেশি বড়লোক নয়, সে কথা ভেবে দেখেন নি। উভয়ের আর্থিক অবস্থা প্রায়ই একরকম। তিনটে ছেলে রোজগারী বলে নিজেদেরকে খুব বড়লোক ভাবেন। তাই রোকেয়াকে বৌ করতে চান না। কিন্তু হারুনের কথা শুনে শেষমেষ মনের ক্ষোভ মনে চেপে রেখে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
মাস খানেকের মধ্যে নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হয়ে গেল। বর ও বরযাত্রীরা রাত তিনটের সময় গাড়ি করে বৌ নিয়ে ফিরল। কিন্তু বৌকে কেউ ঘরে তুলল না। গেটের কাছে প্রায় তিন ঘন্টা বৌ গাড়িতে বসে রইল।
বাড়ির ভিতর এতক্ষণ ধরে হানুফা বিবি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে চলেছেন। বৌয়ের মা-বাবারা যে সব জিনিসপত্র দিয়েছেন, তা যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনি নিম্নমানের। আত্মীয়-স্বজনেরা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যখন বৌকে ঘরে তুলল তখন সকাল ছটা।
বৌকে তোলার পর হানুফা বিবির সেই জা তার সাথে তাল মিলিয়ে বলতে লাগলেন, এটা দেয়নি, ওটা দেয়নি। আমার মা-বাবারা এমন কোনো জিনিস দিতে বাকি রাখেনি, যা দেখে কেউ একটু মুখ খুলতে পারেনি।
হানুফা বিবি বললেন, আমি জানতাম ওরা গরিব। কোথা থেকে অত কিছু দেবে? এমন ছোটোলোকের ঘরের মেয়েকে আমি বৌ করতে চাইনি। এমন অলক্ষ্মী মেয়েকে নিয়ে আমি চলতে পারব না। সেই জন্যে আমি প্রথম থেকেই অমত করেছি। ঐ মেয়েকে আমার পছন্দও হয়নি, আর কোনোকালে হবেও না।