বিয়ে বাড়িতে তিন দিন থেকে চার দিনের দিন রোকেয়া সবাইয়ের সাথে নানার বাড়ি ফিরে এল। তারপরের দিন জুলেখা ও রোকেয়া নিজেদের বাড়ি বদরপুর চলে এল।
.
০২.
বদরপুর গ্রামের প্রায় এক মাইল পূর্ব দিকে মুনসীরহাট গ্রাম। এই গ্রামের ছেলে হারুন। তার বাবার নাম বদরুদ্দিন। মায়ের নাম হনুফা বিবি। বদরুদ্দিন বছর পাঁচেক আগে এ্যাকসিডেন্ট করে অনেক দিন হাসপাতালে ছিলেন। মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। তাই সুস্থ হওয়ার পরও মাথায় গোলমাল থেকে যায়। কখনো ভালো থাকেন। আবার কখনো পাগলের মত আচরণ করেন। ওঁদের শুধু সাত ছেলে। কোনো মেয়ে নেই। হারুন সবার বড়। সে ম্যাট্রিক পাশ করে দুবাইয়ে চাকরি কর। তার মেজ ও সেজ ভাই শামসু ও হোসেনকে সে দুবাইয়ে নিয়ে গিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করে। দিয়েছে। চার নাম্বার ভাই মজিদ পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সংসার দেখাশুনা করে। তারপরের ভাইগুলো স্কুলে পড়ে। তাদের আর্থিক অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো। একতলা বেশ কয়েকটা পাকা রুম করেছে। জমি জায়গাও কিছু কিনেছে।
বদরপুর গ্রামে হাই স্কুল নেই। তাই এই গ্রামের ছেলেমেয়েরা মুনসীরহাট জি এণ্ড আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে। রোকেয়া ঐ বিদ্যালয়ে ক্লাস টেনে পড়ে। তার বড় ভাই জাভেদ এই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কাতারে চাকরি করছে। মেজ ভাই বখতিয়ারও এই স্কুলে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে চাঁদপুরে হোস্টেলে থেকে কলেঝে পড়ছে। দুভাইয়ের পর রূপা, তারপর রোকেয়া। রোকেয়ার পর জুলেখা এবং সকলের ছোট বাহাদুর। জুলেখাও এই স্কুলের সেভেনের ছাত্রী। আর বাহাদুর গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাশ ফোরে পড়ে।
বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর রোকেয়ার প্রায়ই হারুনের কথা মনে পড়ে, ছেলেটা দেখতে বেশ সুন্দর। ভাবে, আমার কথা আজিজ মামাকে কেন জিজ্ঞেস করল? আমার দিকেই বা অমন করে চেয়েছিল কেন? চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার কথা হলে এখনো তাকে লজ্জা পায়।
একদিন রোকেয়া স্কুল ছুটির পর বান্ধবী লাকির সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল। লাকি ও সে। নিচের ক্লাস থেকে এক সঙ্গে পড়ে আসছে। রোকেয়া হঠাৎ দেখতে পেল,হারুন সামনে তেমাথা রাস্তার নীমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে। রোকেয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে চলে যেতে লাগল।
হারুন আস্তে করে বলল, শুনুন।
দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। লাকি খুব চালাক চতুর ও মুখরা মেয়ে। সে হারুনের দিকে চেয়ে বলল, রাস্তায় মেয়েদের একাকি পেলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে বুঝি? আপনি আজিজ ভাইয়ের বন্ধু বলে কিছু বললাম না। নচেৎ মেয়েদের সঙ্গে এভাবে ডেকে কথা বলার মজা বুঝিয়ে দিতাম।
লাকির কথা শুনে হারুন লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেণ্ড কথা বলতে পারল না। তারপর বলল, দেখুন, আপনারা আমাকে যা ভাবছেন, সে রকম ছেলৈ আমি নই। আপনি তো দেখছি আমাকে চেনেন। আমি কিন্তু আপনাকে না চিনলেও আপনার সঙ্গিনীকে চিনি। উনি আমার বন্ধু আজিজের ভাগ্নি।
লাকি বলল, তাতে কি হয়েছে? বন্ধুর ভাগনী হলেই পথে ঘাটে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে নাকি? আপনার বাড়ি কোথায়?
হারুন আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার বাড়ি এই মুনসীরহাটেই। আমি ওঁর সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই।
লাকি রোকেয়াকে বলল, কিরে তুই ওঁকে চিনিস নাকি?
রোকেয়া হারুনকে দেখে মনে মনে পুলকিত হলেও বেশ লজ্জা পেয়েছিল। এখন তার কথা শুনে আরো বেশি লজ্জা পেয়ে কথা বলতে পারল না। নিজের অজান্তে শুধু হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।
লাকি অবাক হয়ে একটু চিন্তা করে হারুনকে বলল, ওর সাথে কি কথা বলবেন বলছিলেন, তাড়াতাড়ি বলুন।
হারুন বলল, কথা এমন কিছু নয়, আমি আপনাদের নাম জানতে চাই।
লাকি বলল, নাম জেনে কি করবেন? তবু বলছি, আমার নাম লাকি। আর ও যখন আপনার বন্ধুর ভাগনী তখন নাম নিশ্চয়ই জানেন?
হারুন বলল না। তাকে জিজ্ঞেস করিনি।
লাকি বলল, ওর নাম রোকেয়া। এবার আসি তাহলে?
হারুন আসুন বলে একবারে রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল।
হারুনকে চলে যেতে দেখে তারাও নিজেদের পথে হাঁটতে লাগল। যেতে যেতে লাকি রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করল, ওকে চিনলি কি করে? কোনো দিনতো তুই ওর কথা আমাকে বলিস নি?
রোকেয়া আজিজ মামার বিয়েতে গিয়ে যা হয়েছিল, তা বলে বলল, তারপর এই আজ দেখা। ওর কথা কি আর তোকে বলব?
লাকি বলল, কিন্তু তোদের দুজনের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে, তোরা প্রেমে পড়েছিস।
রোকেয়া একটু রেগে গিয়ে বলল, কি বাজে বকছিস?
মনে হচ্ছে আমার কথায় রেগে গেছিস? তারপর হেসে ফেলে বলল, প্রেমে পড়লে প্রথম প্রথম সে কথা কেউ বললে সবাই রেগে যায়।
তুই জানলি কি করে? তুইও তাহলে কারো প্রেমে পড়েছিস?
পড়লে তো তুই জানতে পারতিস। প্রেমের পথে আমি কোনোদিন পা বাড়াব না।
কেন?
প্রেম নাকি মানুষকে সব সময় কাঁদায়।
ধেৎ বাজে কথা। প্রেম মানে আনন্দ। সেখানে কান্না থাকবে কেন?
লাকি বলল, আমার চাচাতো ভাই তার মামাতো বোনের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছিল। এখন তাদের এমন একটা দিন অতিবাহিত হয়নি, যেদিন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়নি। দুজনেই এখন অনুতপ্ত। বলে প্রেম করে বিয়ে না করে মা-বাবার পছন্দমত বিয়ে করলে, এমন অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হত না। তুই উপন্যাস পড়িস কিনা জানি না, আমি কিন্তু পড়ি। ভাইয়া ভাবিকে পড়ার জন্য এনে দেয়। আমি চুরি করে পড়ি। তাতেও দেখি যারা প্রেম করে বিয়ে করে, সাংসারিক জীবনে তারা সুখ শান্তি পায় না। তবে সবক্ষেত্রে যে এ রকম হয়, তা নয়। খুব কম প্রেমিক প্রেমিকা দাম্পত্য জীবনে সুখ শান্তি পায়।