ইতি
হতভাগী রোকেয়া।
পুনশ্চ রোকসানা তোমাকে সালাম জানিয়েছে। আর আসার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছে। সে তার আব্বকে জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেনি। দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে।
হারুনকে চিঠি দেওয়ার এক মাস পরও যখন দেশে ফিরল না এবং চিঠিও দিল না তখন বাধ্য হয়ে রোকেয়া নিজে বৎসই দিয়ে অপাশেনের প্রস্তুতি নিল। কারণ পেটের যন্ত্রণায় সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল।
অপারেশনের পর রোকেয়া প্রায় দেড় মাস কুমিল্লায় বড় বোন রূপার বাসায় ছিল। এখন সে আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ। কিন্তু দৈহিক সুস্থ হলে কি হবে? স্বামীর চিন্তায় এবং নিজের ও রোকসানার ভবিষ্যতের চিন্তায় মনে একটুও সুখ-শান্তি নেই।
প্রায় এক বছর পর একদিন হোসেন রোকেয়ার বাপের বাড়িতে এল। হোসেনকে দেখে রোকেয়া বলল, কবে বিদেশ থেকে এলে?
হোসেন বলল, দুদিন হল এসেছি।
রোকেয়া বলল, তোমরা আসছ যাচ্ছ, তোমাদের ভাইয়া আসছে না কেন?
হোসেন বলল, ভাইয়ার খবর ভাইয়া জানে। আমি বলব কেমন করে?
রোকেয়া দেবরের উপর রেগে গেলেও কিছু না বলে চুপ করে রইল।
হোসেন বলল, আমি রোকসানাকে নিতে এসেছি।
রোকেয়া শুনে ভাবতে লাগল, ওরা কি রোকসানাকে একেবারেই নিয়ে যেতে চায়?
ভাবি কিছু বলছে না দেখে হোসেন আবার বলল,তুমি চিন্তা করো না, দুচার দিন পর আমি রোকসানাকে দিয়ে যাব।
রোকেয়া বলল, আমি তোমাদেরকে বিশ্বাস করি না। নিয়ে গিয়ে যদি আর না পাঠাও, তখন আমি কি করব? সবকিছু হারিয়ে রোকসানাকে নিয়ে বেঁচে আছি। ওকে কেড়ে নিলে বাঁচব কেমন করে? একথা বলে সে ফুঁপিয়ে উঠল।
হোসেন বলল, আমি কথা দিচ্ছি ভাবি, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
রোকেয়া একথা শুনে আর আপত্তি করলো না। রোকসানাকে কাপড় পরিয়ে তার সাথে পাঠিয়ে দিল।
কয়েকদিন পর হোসেন রোকসানাকে দিয়ে গেল। এভাবে তিন-চারবার নিয়ে গেল, আবার দিয়েও গেল।
শেষবারে রোকসানা ফিরে এসে মাকে বলল, দাদি তোমার জামা-কাপড় নিয়ে আসার জন্য কাউকে পাঠাতে বলেছে।
মেয়ের মুখে একথা শুনে রোকেয়া ছোট ভাই বাহাদুরকে সেখানে পাঠাল।
বাহাদুর মেজ আপার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তার রুমে ঢুকে জামা-কাপড়গুলো এক জায়গায় করে বাধল।
এমন সময় হানুফা বিবি রুমে ঢুকে তার হাত ধরে বাইরে এনে বললেন, এসব নিয়ে যেতে হলে তোর বাপকে সাথে করে রোকসানার মাকে আসতে বলবি; তারপর চিরকালের মত তোর আপনাকে বিদেয় করে দেব।
বাহাদুর পনের-ষোল বছর বয়সের ছেলে। প্রথমে সে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর বলল, আপনি এখন আবার একথা বলছেন কেন? আপনিই তো রোকসানার হাতে এগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন।
হানুফা বিবি রাগের সাথে বললেন, হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু কিভাবে নিয়ে যেতে হবে, তা তো বলিনি। এখন বললাম।
বাহাদুর বলল, সেজ বিয়াইও তো একদিন এগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য মেজ আপনাকে বলে এল। সেও তো এরকম কিছু বলেনি। আর আব্বাকেই বা আসতে বলছেন কেন? আপনি নিজেই তো মেজ আপাকে বিদেয় করে দিয়েছেন!
হানুফা বিবি বললেন, তুই কুরআন ছুঁয়ে বলতে পারবি, তোর বোনকে আমি বের করে দিয়েছি? সে নিজে চালাকি করে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার নাম করে চলে গেছে। আমি কি তার মতলব বুঝি না? আমার ছেলের টাকা পয়সা নিয়ে তোদেরকে খাওয়াবার জন্য গেছে। আমার ছেলের টাকায় তোর আইবুড়ো বোনের বিয়ে দেবে, তাও কি বুঝিনি মনে করেছিস?
বাহাদুর বলল, আমরা কি গরিব নাকি যে দুলাভাইয়ের টাকায় আপা আমাদের খাওয়াবে? দুলাভাই তো অনেকদিন আগে থেকে টাকা-পয়সা পাঠায়নি।
সেখানে হোসেন ছিল। সে বাহাদুরের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে বলল, বেশি প্যাট প্যাট করবি না, চলে যা, আর কখনো এখানে আসবি না। যা, তোর বাবাকে থানায় গিয়ে মামলা করতে বল। তারপর দেখা যাবে, কে হারে কে জিতে। তোর বাপের কি আর অত টাকা আছে? আমরা টাকার জোরে জিতে যাব।
এমন সময় হারুনের দুজন বড় চাচাতো বোন এসে দেখে-শুনে বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করল, তোর বোন বুঝি বিদেশ চলে যাবে?
তখন বাহাদুর তাদের ব্যবহারে কেঁদে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে একথা শুনে রেগে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, যাবে।
তাদের একজন আবার জিজ্ঞেস করল, তোর বোন শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে এখানে আসবে না?
বাহাদুর বলল, না আসবে না।
অন্যজন জিজ্ঞেস করল, তোদের বাড়ি থেকে সোজা চলে যাবে?
বাহাদুর বলল, হ্যাঁ।
বাহাদুরের কথা শুনে হানুফা বিবি বললেন, এবার বুঝেছি, কেন তোকে জামা কাপড় নিতে পাঠিয়েছে। যা চলে যা, কোনোকিছু নিয়ে যেতে পারবি না। তোর বাপকে বলিস, সে যেন তার মেয়েসহ পাঁচজন লোক নিয়ে এসে একেবারে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বাহাদুর ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে রোকেয়াকে সব কথা জানাল।
শুনে রাগে ও দুঃখে রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। তখন তার স্বামীর উপর ভীষণ রাগ হল। চোখ মুছে ছোট ভাইকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ওরা জামা-কাপড় নিয়ে আসতে বলেছিল বলে তোকে পাঠিয়েছিলাম, নচেৎ পাঠাতাম না। আর কখনো তোকে পাঠাব না ভাই। তুইও কোনোদিন আর ওদের বাড়ি যাবি না। আর কাদিস না চুপ কর। তোকে পাঠিয়ে আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে।
বাহাদুর চোখ মুছে বলল, সেকথা আর তোমাকে বলে দিতে হবে না। তারপর সে সেখান থেকে চলে গেল।
.
১০.