ইতি
অভাগিনী রোকসানার মা।
রোকেয়া হারুনকে কোনোদিন এভাবে চিঠি দেয়নি। কিন্তু এবারে দিয়েও উত্তর পেল না।
একদিন রোকসানা মাকে কাঁদতে দেখে বলল, তুমি আব্বুর জন্য কাঁদছ কেন? আব্বু এখন আসবে না।
রোকেয়া চোখ মুছে বলল, কেন মামণি, তুমি একথা বললে?
রোকসানা বলল, তুমি খালি আব্বর জন্য কাঁদ, তাই বললাম। দেখ আম্মু, আমার বিয়ে দিতে আব্বু ঠিক আসবে।
রোকেয়া বলল, তুমি তো এখন অনেক ছোট।
রোকসানা বলল, আমার কি এখন বিয়ে হচ্ছে? যখন বড় হব, তখন আব্ব আসবে বুঝলে?
রোকেয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, তা তো নিশ্চয়ই।
.
প্রতি বছর বদরপুর ক্লাবে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়। এবছরও হবে। একদিন বখতিয়ার রোকেয়ার হাতে একটা কবিতা দিয়ে বলল, তোর মেয়েকে এটা মুখস্থ করা। ১৬ই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে ওকে দিয়ে আবৃত্তি করাব।
রোকসানা সেখানে ছিল, মামাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি বলছ মেজ মামা?
বখতিয়ার বলল, হ্যাঁরে সত্যি।
রোকেয়া রোকসানাকে বলল, মামাকে ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে এস। আমি তোমাকে কবিতাটা আবৃত্তি করতে শিখিয়ে দিই।
.
অনুষ্ঠানের দিনে রোকেয়া রোকসানাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে বখতিয়ারের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল।
কয়েকটা ছেলেমেয়ে আবৃত্তি করার পর রোকসানার পালা। সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আসোলামু আলাইকুম, আমার নাম রোকসানা আক্তার। আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করব। কবিতার নাম, খেলার প্রিয় সাইদু বাদশা। লিখেছেন, আলাউদ্দিন চৌধুরী (আলো)।
খেলার প্রিয় সাইদু বাদশা মন বসে না পাঠে,
খেলতে খেলা ফুটবল থাকে সদা মাঠে।
মস্ত বড় খেলুয়াড় হতে চাই জীবনে,
অন্য খেলা খেলে না কখন ভুলে।
শিখতে খেলা যাবে সে বহুদুর জার্মানে,
শিক্ষা শেষে আসবে দেশে চড়ে এক রকেট জানে।
আসার সময় আনবে সাথে হাজার খানেক বল,
দেশটাকে মাঠ বানিয়ে খেলবে খেলা ফুটবল।
কবিতা আবৃত্তি করে রোকসানা একটা খাতাও একটা কলম পুরস্কার পেল।
এর মধ্যে রোকেয়ার বড় বোন রূপা বাপের বাড়ি বেড়াতে এল। রোকেয়াকে দেখে বলল, কিরে তুই যে দেখছি কবরের ধারে পৌঁছে গেছিস?
রোকেয়া বলল, আল্লাহপাকের যা মর্জি তা কে রোধ করবে?
রূপা কয়েকদিন থেকে ফিরে যাওয়ার সময় রোকেয়াকে সাথে করে কুমিল্লা নিয়ে এল। তারপর আবার একটা বড় ডাক্তারকে দেখাল।
ডাক্তার রোকেয়াকে পরীক্ষা করে এক মাসের ওষুধ দিয়ে বললেন, এগুলো খেয়ে। আবার আসবেন।
রোকেয়া এক মাস ওষুধ খেয়ে কোনো উপকার পেল না। তবু আবার সেই ডাক্তারের কাছে এসে সে কথা জানাল।
ডাক্তার আগেকার চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন দেখে আবার রোকেয়াকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে বললেন, আপনার একটা অপারেশন না করালে এ রোগ ভালো হবে না। অপারেশনের জন্য স্বামীর অনুমতি লাগবে। ডাক্তার আগেই জেনেছেন, রোকেয়ার স্বামী দীর্ঘ কয়েক বছর বিদেশে আছেন। তাই বললেন, আপনার স্বামী যদি দেশে থাকতেন, তাহলে এ রোগ হত না। যাই হোক, অপারেশনটা একটু সিরিয়াস ধরনের। অপারেশনটা না করালে অন্ধ হয়ে যাবেন অথবা ব্রেনের মধ্যে দারুণ এ্যাফেক্ট করবে। যার ফলে আপনি পাগল হয়ে যেতে পারেন। আপনি অতি সত্বর স্বামীকে দেশে আসতে বলেন। উনি যদি একান্ত না আসতে পারেন, তবে অনুমতি চেয়ে পাঠান। মনে রাখবেন, যা কিছু করবেন, তাড়াতাড়ি করবেন। এমনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। যত শিঘ্রী সম্ভব অপারেশন করান দরকার। ততদিন আগের ওষুধগুলো খেতে থাকুন।
রোকেয়া বদরপুর ফিরে এসে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বামীকে চিঠি লিখল
প্রিয়তম,
পত্রের প্রথমে তোমাকে জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শতকোটি সালাম ও ভালবাসা। ভালবাসা তুমি নিতে না চাইলেও শেষবারের মত সব উজাড় কর পাঠালাম। গতবার চিঠি লিখার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যতদিন বেঁচে থাকব, আর কোনোদিন। তোমাকে চিঠি দিয়ে বিরক্ত করব না। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে দিতে হল। আশাকরি আল্লাহর ফজলে বেশ ভালোই আছ। নচেৎ এ হতভাগীর কথা তোমার মনে পড়ে না কেন? আমি পরম করুণাময়ের অশেষ করুণায় শুধু প্রাণে বেঁচে আছি। অসুখে ভুগে ভুগে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। ডাক্তার বলেছেন, অতি সত্বর অপারেশ করাতে। নচেৎ আমি বেঁচে থাকলেও পঙ্গু হয়ে যাব। অপারেশনের জন্য ডাক্তার তোমার অনুমতি চেয়েছেন, তাই এ চিঠি দেওয়া। তোমার বণ্ডসই অথবা অনুমতি না হলে উনি অপারেশন করবেন না। তাই তোমার কাছে আমার একান্ত মিনতি, তুমি যত শিঘ্রী পার চলে এস। আমি হয়তো আর বাঁচব না। তাই তোমাকে শেষবারের মত একবার দেখতে চাই। তোমার কাছে আমার আর কোনো দাবি নেই। একান্ত যদি আসতে না পার, তবে চিঠি দিয়ে হলেও অপারেশনের অনুমতি দিও। এবার তোমাকে দুএকটা কথা বলব, শুনে তুমি হয়তো দুঃখ পাবে। তবুও না বলে থাকতে পারছি না। সেজন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তুমি বোধহয় জান, হযরত ওমর (রাঃ) যখন ইসলাম প্রচারের জন্য দেশের পর দেশ অভিযান চালিয়েছেন, তখন তিনি মা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্ত্রীরা স্বামীকে ছেড়ে কতদিন থাকতে পারে? মা আয়েশা (রাঃ) উত্তরে বলেছিলেন, চার মাস। তখন হযরত ওমর (রাঃ) কাসেদ মারফত বিভিন্ন দেশে অভিযানরত সেনাপতিদের খবর পাঠিয়ে দিলেন, যে সমস্ত সৈন্য চার মাসের অধিককাল বিদেশে রয়েছে, তাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দিতে। আর তিনি তাদের স্থলে অন্য সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। শুনেছি হাদিসে আছে, স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে চার বছর যোগাযোগ না রাখে, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপনা-আপনি তালাক হয়ে যায়। স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্যত্র বিয়ে করতে পারে। তুমি আজ পাঁচ-ছবছর বিদেশে রয়েছ। ইসলামী আইন মোতাবেক আমাদের বিয়ে কি টিকে আছে? নেই। এ হাদিস জেনে তুমি হয়তো ভাববে, আমি অন্যত্র বিয়ে করতে চাই। অথবা তুমি আমাকে অন্যত্র বিয়ে করার পরামর্শ দেবে। কিন্তু তুমি জেনে রেখ, কোনোটাই আমি চাই না। যদিও তুমি আমাকে আর নিতে না। চাও, তবুও আমি আজীবন তোমাকে স্মরণ রেখে কাটিয়ে দেব। তবু ঐরকম চিন্তা কোনোদিন মনে স্থান দেব না। তুমি আস আর না আস ভাবব, এটাই আমার তকৃদির। বেশি কিছু লিখে তোমাকে আর বিরক্ত করব না। হয়তো অন্যায় কিছু লিখে ফেললাম, পারলে ক্ষমা করো। আল্লাহ হাফেজ।