.
রোকসানা একদিন মাকে বলল, আম্মু, আমার আব্ব কোথায়? আমি তাকে কোনোদিন দেখিনি।
রোকেয়া বলল, মামণি, তোমার আব্ব বিদেশ গেছে। তুমি তখন ছোট ছিলে। তিনি তোমার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় ও কত খেলনা নিয়ে আসবেন।
রোকসানা বলল, আমার অনেক জামা-কাপড় আছে আর লাগবে না। তুমি আব্বকে আসতে বল। সব ছেলেমেয়েরা তাদের আল্লুকে আব্ব বলে ডাকে। আমারও ডাকতে ইচ্ছে হয়।
রোকেয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, ঠিক আছে, আমি চিঠিতে তোমার কথা লিখে তাকে তাড়াতাড়ি চলে আসবে বলব।
রোকেয়ার চাচাতো ভাইয়ের তুষার নামে একটা সাত-আট মাসের ছেলে আছে। রোকসানা তাকে নিয়ে সারাদিন থাকে। একদিন সে তার মাকে বলল, আম্মু, তুষারের মত একটা ভাইয়া আমাকে এনে দেবে। আমি তাকে নিয়ে খেলা করব।
রোকেয়া বলল, তোমার ঐরকম ভাইয়া কিনতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। অত টাকা আমার কাছে নেই।
রোকসানা বলল, তুমি আল্লুকে চিঠি দিয়ে অনেক টাকা পাঠাতে বল। আব্ব টাকা পাঠালে ঐরকম ভাইয়া কিনে নিয়ে আসবে।
রোকেয়া বলল, তাই হবে।
রোকসানা আবার বলল, আচ্ছা আম্মু, তোমার বাচ্চা হয়নি কেন? তুষারের মত একটা বাচ্চা হলে তাকে আমি কত আদর করতাম। সে আমাকে আপা বলে ডাকত, তাই না আম্মু?
মেয়ের কথা শুনে রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। তাকে বুকে চেপে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আল্লাহ দেননি, তাই হয়নি। আল্লাহ যখন দেবেন, তখন তুমি আদর করো কেমন!
রোকসানা মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।
৯-১০. রোকেয়া অসুখে
০৯.
এদিকে রোকেয়া অসুখে ভুগে ভুগে কংকাল হয়ে গেল। নিজের ও মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে করে আরো কাহিল হয়ে পড়ল। এক-এক সময় ভাবে, এভাবে বেঁচে থাকার। চেয়ে মরণ অনেক ভালো। কয়েকবার আত্মহত্যা করার কথা চিন্তাও করেছে। কিন্তু। আত্মহত্যা মহাপাপ ভেবে তা করতে পারেনি। বাপের বাড়ি এসেছে চার-পাঁচ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। কতদিন আর বাপ-ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাব। হারুন তাকে চিঠিপত্র দিয়ে সান্ত্বনা দিলেও ইদানিং টাকা-পয়সা পাঠায়নি। সে প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে, হে আল্লাহ, তোমার ভেদ তুমি জান। আমার কি হবে, তাও তুমি জান। আমাকে এভাবে দগ্ধে দগ্ধে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ, তা আমি জানি না। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। হয় আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা দাও, নচেৎ আমাকে এ দুনিয়া থেকে তুলে নাও। এর মধ্যে রোকেয়া নিজের অসুখের কথা বিস্তারিত লিখে পর পর কয়েকখানা চিঠি দিল। কিন্তু হারুনের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে রোকেয়া আরো একখানা চিঠি লিখল
ওগো প্রাণের স্বামী,
আমার হাজার হাজার সালাম তোমার পবিত্র কদমে স্থান দিও। আর হতভাগিনী রোকসানার সালাম নিবে। আশাকরি ভালো আছ। আমরাও কোনো প্রকারে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি।
প্রিয়তম, বেশ কিছুদিন থেকে তোমাকে চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাচ্ছি না। এর কারণ জানালে বাধিত হব। বিয়ের আগে বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমাকে পছন্দ কর। বিয়ের পর জানতে পারলাম, তুমি শুধু পছন্দ করনি, তোমার আম্মার অমতে একরকম জোর করে আমাকে বিয়ে করেছ। কারণ তুমি আমাকে অত্যন্ত ভালবাস। বিয়ের পর আমিও তা বুঝতে পেরে তোমাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবেসে ফেলি। সেজন্যে তোমার আম্মার হাজারো অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করে সেই ভালবাসা আজও বাঁচিয়ে রেখেছি। তুমিও আমাকে তোমার আম্মার সবকিছু সহ্য করে সবর করতে বলেছিলে। আমি তোমার সুখের জন্য আজ আট বছরের বেশি হতে চলল, নিশ্চল পাথরের মত চুপ করে সহ্য করে রয়েছি। কিন্তু তুমি স্বামীর কর্তব্য পালন করতে পারনি। বলতে পার প্রিয়, এত বছর তোমার মুখের দিকে চেয়ে সবর করে কি পেলাম? অবশেষে সবর করতে না পেরে আজ কয়েকটা কথা বলব। অন্যায় হবে কিনা জানি না, হলে ক্ষমা করে দিও।
তোমার আম্মা রাজি ছিলেন না, তবু আমাকে বিয়ে করলে কেন? তুমি তো তোমার আম্মা কেমন তা নিশ্চয় জানতে? তারপরও জোর করে এ কাজ করা উচিত হয়েছে? যদি আম্মার কথা তখন মেনে নিতে, তাহলে তোমাকে ও আমাকে এত দুঃখ ও অশান্তি ভোগ করতে হত না। তোমার জিদের জন্য তুমি বেঁচে থাকলেও আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। আর তোমার-আমার একমাত্র সন্তান রোকসানা বাপ থেকেও এতিমের মত মানুষ হচ্ছে। সে বার বার তার আব্বার কথা জিজ্ঞেস করে। আমি বলি বিদেশে আছে, তোমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য আমাকে চিঠি লিখতে বলে। আমি ওকে বলি, তোমার আব্বকে তোমার কথা বলে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি। কতদিন আর ওকে মিথ্যে প্রবোধ দিয়ে ভুলিয়ে রাখব? আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি, তুমি তোমার মায়ের পছন্দমত আরেকটা বিয়ে করে সুখের সংসার পাত। এখনো আবার সেই কথা বলছি, তুমি উঁচু ঘরের ধনী কন্যাকে বিয়ে করে সংসারের সবাইকে নিয়ে সুখে ও শান্তিতে থাক। আমি যেমন আছি তেমন থাকব। তোমাদের সংসারে গিয়ে অশান্তির সৃষ্টি করব না। এ জগতে তোমাকে মুক্তি দিলাম। তোমার প্রতি আমার আর কোনোদিন কোনো কিছু দাবি থাকবে বা। তুমি এখন স্বাধীন। এবার একটা কেন, পারলে চারটে বিয়ে করতে পার। কিন্তু এ জগতে তোমাকে মুক্তি দিলেও পরজগতের জন্য নয়, আল্লাহর কাছে এর ন্যায় বিচার চাইব। তোমাকে আমি মাফ করলেও আমার অন্তর কোনোদিন করবে না। কারণ তুমি ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমার সর্বনাশ করেছ। আরো অনেক কিছু লিখার ছিল। কিন্তু মন চাচ্ছে না। কারণ লিখে কি হবে? তোমার যদি পুরুষত্ব বলে কিছু থাকত, তাহলে স্ত্রীকে ছেড়ে বছরের পর বছর বিদেশে থাকতে পারতে না। আর সবকিছু লিখতে গেলে কয়েক রীম কাগজ লাগবে। যাক, মনের দুঃখে ভালো-মন্দ অনেক কিছু লিখে ফেললাম : নিজ গুণে ক্ষমা করো। আল্লাহপাকের দরবারে তোমার সহি সালামতের দোয়া চেয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।