রোকেয়ার বড় বোন রূপার স্বামী বশির কুমিল্লা টাউনে একটা বড় দোকান দিয়েছে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে অসুবিধে হয় বলে সেখানে বাসা ভাড়া করে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
একদিন রূপা বাপের বাড়ি বেড়াতে এল। এসে রোকেয়া অবস্থা দেখে বলল, কিরে তোর শরীর যে একদম ভেঙে গেছে। ভালো করে চিকিৎসা করাচ্ছিস না কেন? সে বোনের অসুখের কথা জানে।
রোকেয়া বলল, চিকিৎসা তো কম করাছি না; কোনো উপকারই হচ্ছে না।
রূপা বলল, তোকে এবারে আমি কুমিল্লা নিয়ে যাব। তোর দুলাভাইকে বলে বড় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাব।
রোকেয়া বলল, আমার মনে হয়, এ রোগ আর ভালো হবে না। শুধু শুধু টাকা খরচ করে কোনো লাভ নেই।
রূপা বলল, তোর কথা ঠিক নয়। আল্লাহর হুকুম যতদিন না হয়, ততদিন কারো রোগ ভালো হয় না। ওষুধ খেলেও কাজ হয় না। কারণ ওষুধের উপরও আল্লাহর হুকুম থাকে।
রূপা কয়েকদিন থেকে যাওয়ার সময় জোর করে রোকেয়াকে কুমিল্লা নিয়ে এল। তারপর একজন বড় ডাক্তারের কাছে রোকেয়াকে দেখাল।
ডাক্তার রোকেয়াকে পরীক্ষা করে তিন মাসের ওষুধ দিয়ে বললেন, এগুলো শেষ করার পর দেখা করবেন। আর দুচারদিনের মধ্যে মাথার, পেটের ও বুকের এক্স-রে এবং রক্ত, প্রস্রাব ও পায়খানা পরীক্ষা করাতে বললেন।
রোকেয়া আপার বাসায় সাত-আট দিন থেকে ডাক্তারের কথামত সবকিছু করিয়ে ডাক্তারকে দেখাল।
ডাক্তার সব রিপোর্ট দেখে বললেন, ঠিক আছে, আপনাকে যে ওষুধগুলো খেতে দিয়েছি, ঐগুলো খেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
রোকেয়া আরো দুদিন থেকে বদরপুর ফিরে এল। তিন মাস ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হল না। তারপর সেই ডাক্তারের কাছে আর যাওয়া হল না। কারণ রূপা চিঠি দিয়ে জানাল, তিনি বিদেশ চলে গেছেন।
.
হারুনের সেজ ভাই হোসেন দুবছর হল বিদেশ গিয়েছিল। এর মধ্যে সে দেশে ফিরল। একদিন হোসেন ভাবি ও ভাইজীকে দেখার জন্য বদরপুর এল।
বাহাদুর সদরে ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে বলল, বিয়াই, কেমন আছেন?
হোসেন বলল, ভালো আছি। তোমরা সব ভালো আছ?
বাহাদুর বলল, হ্যাঁ, ভালো আছি। তারপর তাকে সদরে বসতে বলে বলল, আপনি বসুন, আমি মেজ আপাকে ডেকে দিচ্ছি। একথা বলে সে বাড়ির ভেতরে গিয়ে রোকেয়াকে বলল, মেজ আপা, হোসেন বিয়াই এসেছে। তাকে আমি সদরে বসতে বলেছি।
রোকেয়া রোকসানাকে সঙ্গে নিয়ে সদরে হোসেনের কাছে এল।
হোসেন সালাম দিয়ে বলল, ভাবি কেমন আছ?
রোকেয়া সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি কেমন আছি, তা তো দেখতেই পাচ্ছ। তোমরা সব কেমন আছ বল।
হোসেন বলল, আমরা ভালো আছি। কিন্তু তোমার শরীর এত ভেঙে গেল কেন?
রোকেয়া ম্লান হেসে বলল, সেকথা তোমার জেনে কোনো লাভ নেই। যার লাভ ছিল সে যখন কোনো খোঁজ-খবর রাখছে না তখন আর বলে কি হবে? যাক,তোমার বড় ভাইয়ার কি খবর? সে দেশে আসছে না কেন?
হোসেন বলল, তা আমি কি করে বলব? বড় ভাইয়ার কথা থাক। আমি তোমাকে ও রোকসানাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি যাবে কিনা বল?
রোকেয়া বলল, আমি যাব না। তুমিও একদিন আমাকে বাপের বাড়ি চলে আসতে বলেছিলে। এখন আবার যেতে বলছ কেন?
হোসেন বলল, আমি তোমার কাছে সে কৈফিয়ত দিতে আসিনি। তুমি যাবে কিনা বল?
রোকেয়া বলল, আমিও তোমাকে সেসব কথা বলতে চাই না। তুমি বলতে বাধ্য করলে, তাই বললাম।
হোসেন বলল, তাহলে তুমি যাবে না?
রোকেয়া বলল, না যাব না।
হোসেন বলল, তাহলে রোকসানাকে নিয়ে যাই।
রোকেয়া বলল, না রোকসানাও যাবে না।
হোসেন বলল, কথা দিচ্ছি, রোকসানাকে কয়েকদিন পরে আমি নিজেই দিয়ে যাব।
রোকেয়া বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।
হোসেন আর কিছু না বলে চলে গেল।
মাসখানেক পর হোসেন আবার একদিন এসে রোকসানাকে দেখে গেল। তার তিন-চার মাস পর বিদেশ যাওয়ার আগের দিন আর একবার রোকসানাকে দেখার জন্য এল। কিন্তু সেদিন রোকসানা বাড়িতে ছিল না। তার নানির সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। তাই হোসেন তাকে দেখতে পেল না।
হোসেন বিদেশে গিয়ে বড় ভাই হারুনকে বলল, আমি রোকসানাকে দেখতে বদরপুর গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবি তাকে দেখা করতে দেয়নি। লুকিয়ে রেখে বলল, সে বেড়াতে গেছে।
কিছুদিন পর হারুন রোকেয়াকে চিঠি দিয়ে বলল, রোকা তুমি কি চিরকাল পাগলামি করবে? হোসেন রোকসানাকে দেখতে গেলে, না দেখিয়ে লুকিয়ে রাখলে কেন?
স্বামীর চিঠি পড়ে রোকেয়ার খুব দুঃখ হল। ভাবল, চিঠিতে কিছু লিখলে ভাববে, আমি সাফাই গাওয়ার জন্য মিথ্যে করে লিখেছি। সে বিদেশ থেকে আসলে রোকসানার মুখ দিয়েই সত্য-মিথ্যা যাচাই করাব। রোকসানা এখন সবকিছু বুঝতে শিখেছে। সে-ই তার বাবাকে বলবে। এসব ভেবে রোকেয়া স্বামীর চিঠির উত্তর দিল না।
হারুন রোকেয়ার কাছ থেকে উত্তর না য়ে আরো দু-তিনখানা চিঠি দিল।
রোকেয়া তবুও উত্তর দিল না। কারণ সে প্রত্যেক চিঠিতে লিখে, আমি আগামী মাসে আসব। অথবা ঈদের পর আসব,না হয় কোরবানীর ঈদের পর আসব। এই আসব আসব করে আজ পাঁচ-ছবছর পার করে দিয়েছে। তবুও আসল না। রোকেয়ার মনে। হল, আসবার কথা লিখে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আসলে সংসারের অশান্তির ভয়ে সে আসবে না।
হানুফা বিবিকে তার সব ছেলেই ভয় করে। ভয় করে না শুধু সেজ ছেলে হোসেন। কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের সময় রোকেয়াকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। বিয়ের পরে হোসেন মাকে বলল, আম্মা, সংসারের ব্যাপারে আমাকে ও আমার বৌকে এবং আমার শ্বশুর বাড়ির কাউকে ভালো-মন্দ কোনোকিছু বলবে না। যেদিন : বলবে, সেদিন তুলকালাম কাণ্ড করে ছাড়ব। সেই ভয়ে হনুফা বিবি তেমন বেশি কিছু না বললেও মাঝে-মধ্যে বৌকে বকাঝকা করতে ছাড়েননি। ঐ যে লোকে বলে, ইজ্জত যায় না ধুলে, আর স্বভাব যায় না মরলে।