রোকেয়া দেবরকে খুশি করার জন্য মাকে বলল, মেজ ভাইয়ের কি কাণ্ড দেখ আম্মা, সে আমার দেবরকে না বলে ডাক্তারখানা থেকে রোকসানাকে নিয়ে চলে এসেছে। আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তো আনতে পারত? তারপর মজিদকে আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিল।
কয়েকদিন পরে মজিদ রোকসানাকে নিয়ে যেতে এলে রোকেয়া বলল, তোমরা মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আর দিয়ে যাও না। কেউ আনতে গেলে তার সাথেও পাঠাও না। আমি রোকসানাকে আর ওখানে পাঠাব না।
এরপর একদিন হারুনের দুভাই হানিফ ও মজিদ রোকসানাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুলে গেল। কিন্তু সেদিন রোকসানা স্কুলে যায়নি। তাই তারা ফিরে গেল।
সেদিন রোকেয়ার এক চাচাতো বোন এসে বলল, জান আপা, আজ স্কুল থেকে রোকসানাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওর দুই চাচা এসেছিল, রোকসানাকে না পেয়ে ফিরে গেছে।
তারপর থেকে রোকেয়া রোকসানাকে আর স্কুলে পাঠাল না। নিজে তাকে ঘরে পড়াতে লাগল। শুধু পরীক্ষার সময় শাহেদ আলী নিজে নাতনিকে সাথে করে স্কুলে নিয়ে যান নিয়ে আসেন। এভাবে দিন অতিবাহিত হতে লাগল।
.
রোকসানার বয়স এখন সাত বছর। সে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। একদিন দুবাই থেকে হারুনের চিঠি এল। রোকেয়া চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।
প্রিয়তমা আমার,
আমি তোমার বিরহে দিন-রাত অস্থির হয়ে আছি। এই সুদূর বিদেশে কেবলই তোমার শেফালি শুভ্র মুখখানা মনে পড়ে। কয়েকদিন ধরে তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় তোমার চিঠির আশায় প্রহর গুনছিলাম। আজ তোমার প্রেরিত টক-ঝাল-মিষ্টি মেশান চিঠি পেয়ে আমার তৃষ্ণা মিটল। তবে দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? যাক, তুমি ভালো আছ জেনে আমার মরা গাছে যেন ফুল ফুটল। শরীরে ও প্রাণে স্পন্দন জাগল। আর তুমি কি না, আমি তোমাকে ভুলে গেছি বলে অভিযোগ করেছ। সত্যি কি তোমাকে ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব? গ্রহ ছাড়া কি উপগ্রহ থাকতে পারে? তুমি যে আমার মরুদ্যানের সজল মৌসুমী বায়ু। তোমার লক্ষ লক্ষ টন পানি চুষে এ মরুদ্যান সবুজ শ্যামল ফুলে-ফলে ভরপুর হবে। সেই আমি কি করে তোমায় ভুলে থাকব? ছায়া বরং কায়ার মায়ায় বিস্মৃত হয়ে পিছু হটতে পারে, পূর্বদিকে সূর্য না উঠে পশ্চিম দিকে উঠতে পারে, কিন্তু আমি কোনোদিন তোমাকে ভুলতে পারব না। আসলে কি জান রোকা, তোমার কাছে যাওয়ার জন্য আমার মন উন্মাদ হলে কি হবে, যখন সংসারের অশান্তির কথা মনে পড়ে, তখন আর দেশে যেতে আমার মোটেই ইচ্ছে করে না। তবে এবার ঠিক যাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না। মামণি রোকসানার জন্যও আমার মন খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। ওকে আমার আন্তরিক দোয়া ও স্নেহচুম্বন দিও। পরিশেষে আল্লাহপাকের দরবারে তোমাকে ও রোকসানাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরামে রাখার জন্য। দোয়া করছি। সবশেষে তোমার তুলতুলে দুগালে কয়েকটা চুমো দিলাম।
ইতি
হারুন
রোকেয়া হারনের চিঠি পড়ে তার উত্তর লিখল,
ওগো প্রাণ সজনী,
তোমাকে জানাই আমার শতকোটি সালাম ও প্রেম-ভালবাসা। কেমন আছ? নিশ্চয় ভালো? আল্লাহপাকের কাছে আমিও তাই কামনা করি। আজ তোমার উচ্ছ্বাস ও আনন্দ মেশানো চিঠি আমার হস্তগত হল। চিঠিটা পড়ে আমার উষ্ণমনে এক পশলা বৃষ্টি বয়ে এনেছে। নিঃসঙ্গতার বেদনা ও জ্বলন্ত বিরহের মাঝে সেই বৃষ্টি শান্তির ধারা বর্ষিত হয়েছে। ওগো প্রাণপ্রিয় স্বামী, তোমার স্মৃতি ও ভালবাসা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রেরণা জোগাচ্ছে। তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাস জানি, আমি কিন্তু মন-প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালবাসি। তুমি যাদুমাখা চিঠি দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে রেখে অভিনয় করে চলেছ। এটা কি স্বামীর কর্তব্য? না এটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালবাসার স্বরূপ? আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ আট বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে আমরা একত্রে বাস করেছি ছয়-সাত মাস। আর বাকি সময়গুলো বিরহের মধ্যে কেটেছে। কিসের ভয়ে আসছ না? তুমি না পুরুষ? তুমি এসে আমাদের সমস্যাটা সমাধান করে যাও। সবাই যেন সুখে থাকে সে ব্যবস্থা কর। তোমার আম্মা তো আমাকে অপছন্দ করেই। এখন তুমি যদি আমাকে নিয়ে সংসার করতে না চাও, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি চাই তোমাদের সকলের সুখ-শান্তি। সংসারে অশান্তির কারণে তুমি স্ত্রী ও মেয়েকে ফেলে রেখে বিদেশে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে-এটা কখনো হতে পারে না। তুমি ফিরে আস। কপালে যা আছে, তা না হয়ে যাবে না। অদৃষ্টের লিখন কে করিবে খণ্ডন? এদিকে আমার শরীর একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। যাকে বলে জীবন্ত কংকাল। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, রোকসানার কথাও কি তোমার মনে পড়ছে না? সে তোমাকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে কান্নাকাটি করে। তার কথা মনে করে হলেও তোমার একবার দেশে আসা উচিত। বিশেষ আর কি লিখব। আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন তোমায় সুখে রাখেন।
ইয়ি
তোমার অভাগিনী রোকা।
রোকেয়ার শরীর দিনের পর দিন জীর্ণ হয়ে পড়ছে। একে স্বামীর ও সংসারের চিন্তা। তার উপর রোকসানা হওয়ার দুবছর পর থেকে তার পেটে এক ধরনের ব্যথা শুরু হয়েছে। আজ প্রায় ছবছর হতে চলল, প্রতিমাসে একবার করে কয়েক দিন ব্যথাটা হয়। প্রথম তিন দিন তো পেটের ব্যথায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। এমনভাবে পেটে কামড় দেয়, যা সে বলতে পারে না। পায়খানা করতে খুব কষ্ট হয়। মনে হয়, প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তিন দিন পর পেট ফুলে যায়। পাঁচ-ছদিন পর ভালো হয়ে যায়। এতদিন কত হোমিওপ্যাথিক, এ্যালোপ্যাথিক, কবিরাজী ও হেকিমি চিকিৎসা করিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এখন সেই ব্যথা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।