উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, এরকম হচ্ছে কেন? তোমাকে কি কেউ তাবিজ করেছে?
রোকেয়া বলল, তা আমি বলব কি করে?
হানুফা বিবি বলে উঠলেন, এসব আমার বদনাম করার জন্য বলছে।
চাচি শাশুড়ী হনুফা বিবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যেতে চাচ্ছে যাক। তোমার। বদনাম করে আর কি করবে? ওর তো আর বিয়ে হবে না।
হানুফা বিবি বললেন, না না, এখন যেতে পারবে না। গেলে পাঁচজনের সামনে একেবারে যাবে।
চাচি শাশুড়ী বললেন, বৌ জোর করে গেলে, তুমি কি ধরে রাখতে পারবে?
হানুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, একান্ত যদি যাও, তবে আমার কোনো বদনাম করতে বা দোষ দিতে পারবে না।
চাচি শাশুড়ী বললেন, তুমি বললেই কি আর না বললেই কি? তোমার বদনাম যেমন। হবে, তেমনি সবাই দোষও দিবে। একথা বলে তিনি চলে গেলেন।
রোকেয়া তৈরি হয়েছিল। শাশুড়ীকে সালাম করার জন্য এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আপনাদের বদনাম বা দোষ কোনোদিন দেব না। সবই আমার তকৃদির। তারপর বসে পায়ে হাত দিতে গেল।
হানুফা বিবি তাকে ঠেলে ফেলে দিলেন।
রোকেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে রোকসানাকে বলল, যাও দাদিকে সালাম কর।
রোকসানা সালাম করতে গেলে হনুফা বিবি তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
রোকসানা বলল, দাদি তো বাথরুমে চলে গেল। সালাম করব কি করে?
রোকেয়া বলল, দাঁড়াও উনি একটু পরে বেরিয়ে আসবেন।
প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে যেতেও যখন হানুফা বিবি বাথরুম থেকে বার হলেন না তখন রোকেয়া রোকসানাকে নিয়ে বাহাদুরের সাথে বাপের বাড়ি চলে গেল।
বাপের বাড়িতে এসে রোকেয়া বাবা-মাকে জানাল, সে আর কখনো শ্বশুর বাড়ি যাবে না।
শাহেদ আলী বললেন, তোকে তো আমি অনেক আগেই সেকথা বলেছিলাম।
মেহেরুন্নেসা বললেন, জামাই এসে যদি নিয়ে যেতে চায়?
শাহেদ আলী বললেন, জামাই যদি রোকেয়াকে নিয়ে অন্য জায়গায় আলাদা সংসার করতে পারে, তাহলে পাঠাব, নচেৎ পাঠাব না। আগে জামাই আসুক, তারপর যা করার করা যাবে।
রোকসানাকে পেয়ে এ বাড়ির সবাই খুশি। কারণ এ বাড়িতে আর কোনো ঘোট ছেলেমেয়ে নেই। জাভেদের শুধু দুটো ছেলেমেয়ে। মনোয়ারা ও মানিক। তারা বড় হয়ে গেছে।
রোকেয়া বাপের বাড়িতে চলে আসার পর স্বামীকে সবকিছু জানিয়ে পত্র দিল।
হারুন পত্র পেয়ে টেলিফোন করে রোকেয়াকে বলল, তুমি যা করেছ, তা ভালোই করেছ। আমি তোমাকে মাঝে মাঝে টেলিফোন করব, পত্র দেব, টাকা-পয়সাও পাঠাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না।
রোকেয়া বলল, তুমি দেশে আসছ না কেন? যত তাড়াতাড়ি পার কয়েকদিনের জন্য হলেও আস। কতদিন তোমাকে দেখিনি। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
হারুন বলল, তোমাদের জন্য আমারও মন খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোম্পানী কিছুতেই ছুটি দিচ্ছে না। তবু আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এবার ছাড়ছি, পত্রে সবকিছু লিখে জানাব। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোন ছেড়ে দিল।
এরপর থেকে হারুন মাঝে মাঝে রোকেয়াকে টেলিফোন করে, পত্র দেয় এবং টাকা-পয়সাও পাঠায়। এভাবে দিন, মাস ও বছর গড়িয়ে চলল।
একদিন জুলেখা রোকেয়াকে বলল, মেজ আপা, এবার রোকসানাকে স্কুলে ভর্তি করে দাও।
রোকেয়া বলল, এখন রোকসানা ছোট, আর একটু বড় হোক তখন ভর্তি করব।
জুলেখা শুনল না, সে নিজে রোকসানাকে ভর্তি করে দিল।
.
রোকেয়া শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসার কিছুদিন পর থেকে হারুনের ছোট ভাইয়েরা এসে মাঝে মাঝে রোকসানাকে নিয়ে যায়। কয়েকদিন রেখে আবার দিয়েও যায়। এভাবে পাঁচ-ছমাস পরে একবার রোকসানাকে নিয়ে গিয়ে প্রায় পনের বিশ দিন রেখেছিল। রোকেয়া মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। শেষে তার চাচাতো ভাই দুলালকে রোকসানাকে নিয়ে আসার জন্য মুন্সীরহাটে পাঠাল। কিন্তু তারা রোকসানাকে দুলালের সাথে দিল না। বরং তাকে যাতা বলে ফিরিয়ে দিল। কিছুদিন পর রোকেয়া বাহাদুরকে পাঠাল। তাকেও তারা যাতা বলে ফিরিয়ে দিল। এমন কি তাকে রোকসানাকে দেখতেও দিল না। তার উপর বলে দিল, রোকসানা তাদের মেয়ে তাদের কাছে থাকবে। এভাবে একমাস পার হয়ে যেতে মেয়ের জন্য রোকেয়া আরো অস্থির হয়ে পড়ল।
একদিন রোকেয়ার চার নাম্বার দেবর মজিদ রোকসানাকে এক ডাক্তারখানায় বসিয়ে রেখে বাজার করতে গিয়েছিল।
সেই পথ দিয়ে রোকেয়ার মেজ ভাই বখতিয়ার বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ রোকসানাকে ডাক্তারখানায় একা বসে থাকতে দেখে তার কাছে গেল।
রোকসানা মামাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল, মেজ মামা, আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে চল। আমি দাদিদের বাড়িতে আর থাকর না।
বখতিয়ার তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কার সঙ্গে এখানে এসেছ?
রোকসানা বলল, মজিদ চাচুর সঙ্গে। সে বাজারে গেছে।
তখন বখতিয়ার তাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এল।
ঘরে এসে রোকসানা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মু, আমি আর দাদিদের বাড়িতে যাব না।
রোকেয়া এতদিন পরে মেয়েকে পেয়ে বুকে চেপে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, না মা আমিও আর তোমাকে সেখানে পাঠাব না।
এদিকে মজিদ বাজার থেকে ফিরে এসে ডাক্তারখানায় রোকসানাকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজি করল। শেষে না পেয়ে ভাবল, তাহলে ওর মামারা কেউ ওকে একা পেয়ে কি এখান থেকে নিয়ে গেছে? একথা ভেবে রোকসানার মামাদের বাড়িতে গেল। ভাবির কোলে রোকসানাকে দেখে মজিদ বলল, এভাবে চুরি করে আনার কি দরকার ছিল? ঘর থেকে আনতে গেলে আমরা কি মেয়েকে দিতাম না?