হানুফা বিবি শায়লাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কি আমি রোকসানার মাকে আনতে পাঠিয়েছিলাম, না তুমি তার অসুখের কথা শুনে তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য আমার হুকুম নিয়েছিলে? আমি তো বলেছিলাম, তাকে দেখেই চলে আসবে। আনতে গেলে কেন?
শায়লা কাচুমাচু হয়ে বলল, আম্মা, আমাকে মাফ করে দিন। এ ধরনের ভুল আমি আর কখনো করব না। আমাকে গালাগালি করবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না। তারপর রোকেয়াকে বলল, বুবু আমি না হয় কথাটা বলেই ফেলেছি, তাই বলে তুমি আম্মাকে বলে দিলে কেন?
রোকেয়া বলল, সবাই আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে দিয়ে অনেক অপমান করেছে। আমি আর অপমান সহ্য করত পারছি না। এখন থেকে আর চুপ করেও থাকব না। কাউকে ভয়ও করব না। তাতে আমার কপালে আল্লাহ যা রেখেছেন, তাই হবে।
সেদিন তারপর আর কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না।
.
০৮.
রোকেয়া মাসখানেক থেকে বাপের বাড়ি চলে গেল। সেখানে সপ্তাহ খানেক থেকে আবার শ্বশুর বাড়ি ফিরে এল। তারপর রান্না করার সময় শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করল, আম্মা চাল কত নেব?
হানুফা বিবি বললেন, তুই যখন ছিলি না, তখন এক সের দিয়ে আমাদের সবাইয়ের হয়েও বেঁচে গেছে। এখন তুই ও তোর মেয়ে যখন এসেছিস, তখন দেড় সের নে।
রোকেয়া বলল, আমি আমার মেয়ে কি এক বেলায় আধ সের চাল খাই?
হানুফা বিবি বললেন, না, তোরা মা-মেয়ে বাতাস খেয়ে থাকিস। তোদের জন্য আমার সবদিকে ক্ষতি হচ্ছে। তেল, সাবান ও খাওয়া-দাওয়ায় আমাদের সাত আটজনের যা লাগে, তার চেয়ে তোদের দুজনের বেশি লাগে.। বল, এগুলো আমি পাব কোথায়? সারাদিন তো একটাও কাজ করিস না, আর কাজ করতেও জানিস না। তুই কি আমাদের মেরে ফেলতে চাস? না বাপু, আর পারছি না। এবার ক্ষমা করে বিদায় হও। তোর ছেলে হয়নি বলে শামসুর ছেলেকে হিংসা করিস। তাকে দেখতে পারিস না। সেজন্য কোনোদিন কোলেও নিসনি।
শাশুড়ীর কথা শুনে রোকেয়া কাঁদতে কাঁদতে শায়লাকে বলল, আমি নাকি তোমার ছেলেকে হিংসা করি, কোনোদিন কোলেও নেইনি?
শায়লা শাশুড়ীর মন রাখার জন্য বলল,আম্মা না দেখলে কি আর মিথ্যে করে বলছে?
একথা শুনে রোকেয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, আম্মার কথা বাদ দাও, তুমি দেখেছ কিনা বল?
শায়লা বলল, আমি দেখলে কি হবে, আম্মা তো দেখেনি?
রোকেয়া তখন শাশুড়ীকে বলল, আম্মা, আল্লাহর নামে কসম করে বলুন তো, আমি মেজ ভাইয়ের ছেলেকে হিংসা করি বা কখনো তাকে কোলে নেইনি।
হানুফা বিবি বললেন, তোর কথায় কসম করতে যাব কেন? আমি দেখেছি বলেই
তো বললাম। তোর জন্য মেজ বৌকে শিক্ষা দিতে পারছি না। তুই সবকিছুর ক্ষতির কারণ। তুই নিজে খারাপ, তাই এই বৌকেও খারাপ করছিস। তারপর শায়লাকে। বললেন, তোমাকে এত করে বলি যে, ওর সাথে একটুও মিশবে না। তোমাকে যে খারাপ করছে, সেকথা এখন না বুঝতে পারলেও পরে বুঝতে পারবে। আর রোকসানার মাকেও কতদিন ধরে বলে আসছি চলে যেতে। যাবে কেন? খেতে-পরতে পেলে কেউ কি যেতে চায়?
রোকেয়া কিছু না বলে চিন্তা করল, শায়লা শাশুড়ীর সঙ্গে তাল দিয়ে চলছে।
কয়েকদিন পর এক বিকেলে রোকেয়ার ছোট ভাই বাহাদুর এলে রোকেয়া বাপের বাড়ি চলে যেতে চাইল।
শায়লা জানতে পেরে বলল, বুবু তুমি যেও না। আম্মা তো প্রায়ই তোমাকে ঐসব বলে থাকেন।
রোকেয়া বুঝতে পারল, সে চলে গেলে সংসারের সব কাজ শায়লাকে করতে হবে। তাই বাধা দিচ্ছে।
তখন তার বিগত দিনের কথা মনের পাতায় ভেসে উঠল। সে থাকলে হানুফা বিবি মেজ বৌকে কোনো কাজ করতে দেন না। তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, সব কাজ রোকসানার মা করবে। তুমি করতে যাবে কেন? তিনি মেজ বৌকে সঙ্গে নিয়ে বসে বসে গল্প করেন। আর রোকেয়া চাকরাণীর মত খাটে। শায়লা মাঝে মাঝে এটা-সেটা করতে গেলে হনুফা বিবি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান। একদিনের ঘটনা, রোকেয়ার তখন খুব জ্বর। কিছু খেতে পারে না। পরের দিন সকালে বিছানা থেকে উঠে রান্না ঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসল। সেখানে হানুফা বিবি শায়লাকে নিয়ে চা-নাস্তা খাচ্ছিলেন। রোকেয়াকে বসে থাকতে দেখেও কেউ খেতে ডাকল না। হনুফা বিবি খাচ্ছেন আর কি কথা নিয়ে হাসাহাসি করছেন। রোকেয়া আর বসে থাকতে পারল না। রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল।
রোকেয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে শায়লা বলল, বুবু, তুমি কি আমার কথা রাখবে না?
শায়লার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে রোকেয়া বলল, না, আমি এখন আর কারো কথা শুনব না। তারপর সে বাহাদুরের সাথে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগল।
তাই দেখে হানুফা বিবি বললেন, এভাবে যেতে পারবি না। তোর বাবাকে দু পাঁচজন লোক নিয়ে আসতে বল। তাদের সামনে তোকে চিরকালের মত বিদেয় করব। এখন তো আমি তোকে যেতে বলিনি।
রোকেয়া বলল, পাঁচজনকে লাগবে না; আর আপনি এখন যেতে না বললেও কত হাজার বার বলেছেন। যাইনি বলে কয়েকবার হাত ধরে বের করে দিয়েছেন। আজ আবার লোকজনদের জানাবার কি দরকার?
হানুফা বিবি তাড়াতাড়ি ছোট জাকে ডেকে এনে বললেন, দেখ, রোকসানার মা এখন বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে; কিন্তু তোমরা আবার পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। আর সেও যেন আমাকে দোষ দিতে না পারে, তাই তোমাকে ডেকে আনলাম। হানুফা বিবির ছোট জা রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চলে যাচ্ছ কেন? রোকেয়া বলল, ছোট মা বিশ্বাস করুন, এখানে আমার আর একদণ্ড মন টিকছে। খুব অস্থির লাগছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।