হানুফা বিবি কোনোদিন রোকেয়াকে রা করতে দেখেননি। আজ এত কথা বলতে শুনে বেশ একটু দমে গেলেন। গলার স্বর নামিয়ে বললেন, যাবি কি করে? বাপ-ভাই খাওয়াতে পারলে তো যাবি? তারপর কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললেন, এখন বল, আমার বুড়ো মা এলে রিশ করে মুখ ভার করে থাকিস কেন? এটা তো আর মিথ্যে না? সকলের সামনেই আম্মা বলল!
তখন রমযান মাস। রোকেয়া নানি শাশুড়ির দুহাত ধরে বলল, নানি আপনি রোযা মুখে বলুন, আমি আপনার প্রতি রিশ করে মুখ ভার করে থাকি কি না?
একথা শুনে সখিনা বিবি কেঁদে ফেললেন। বললেন, নাতবৌ হিসেবে আমি তোমাকে নিয়ে একটু ঠাট্টা করেছি। আর সেই কথা নিয়ে তোমার শাশুড়ী এমন করবে ভাবতেই পারিনি। তাকে বোঝালেও বোঝে না। বাবা আর আমি কোনোদিন এখানে। আসব না! একথা বলে তিনি চলে যেতে চাইলেন।
রোকেয়া চিন্তা করল, এখন যদি নানি চলে যান, তাহলে শাশুড়ী তার উপর আরো জুলুম করবে। তাই সে নানির হাতে-পায়ে ধরে যেতে দিল না।
পরের দিন রোকেয়া হারুনকে চিঠি দিল। চিঠিতে বাড়ির বিস্তারিত সবকিছু লেখার পর আরো লিখল, তোমার বাড়ি আর এক মুহূর্তে থাকতে আমার ইচ্ছা হয় না। তবে তুমি যদি বল, তোমার মেজ ভাইয়ের বৌয়ের দাসীগিরী করে খেতে, তাহলে তাই হয়ে খাব। নচেৎ তুমি এসে এর একটা ফায়সালা করে যাও।
হারুন তার পত্রের উত্তরে জানাল, রোকা, তুমি পত্র পাওয়ার সাথে সাথে বাপের বাড়ি চলে যেও। আমি টাকা পাঠালে খাবে নচেৎ না খেয়ে থাকবে। আর একটা কথা মনে রেখ, কেউ যদি বলে, তোমাদের খাওয়াতে পারছি না, তাই বাপের বাড়ি চলে এসেছ, তাহলে সেদিন আমার মরণের খবর পাবে।
হারুনের পত্র পেয়ে রোকেয়া বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার নাম করে চলে এল।
মাস দেড়েক পর রোকেয়ার মেজ জা শায়লা একদিন তাকে নিয়ে যেতে এল। রোকেয়ার মা-বাবা ও বাড়ির অন্যান্য সকলে তাকে যেতে বারণ করল।
কিন্তু শায়লা নাছোড় বান্দা। বলল, বুবুকে না নিয়ে আমি একা ফিরে যাব না।
শায়লার জেদাজেদিতে রোকেয়ার মন একটু নরম হল। মা-বাবাকে বলল, আমার জা যখন আশা করে নিয়ে যেতে এসেছে তখন তাকে যদি ফিরিয়ে দিই, আর সেকথা যদি তোমার জামাই শুনে, তাহলে সে খুব মনে কষ্ট পাবে। অথবা আমাকে ও তোমাদেরকে অন্যরকম ভাববে। তার চেয়ে আমি ওর সঙ্গে যাই।
দুদিন আগে থেকে রোকেয়ার খুব জ্বর। তার কথা শুনে মেহেরুন্নেসা মেয়েকে বললেন, তুই যে যাবি বলছিস, তোর গায়ে তো এখনো বেশ জ্বর রয়েছে। এই কদিন আগে ডায়রিয়ায় ভুগলি। তারপর জ্বর হয়েছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে যাবি কি করে? শরীর ভালো হোক, তারপর না হয় যাবি।
রোকেয়া বলল, তোমরা বাধা দিও না আম্মা। আল্লাহ চাহে তো জ্বর দুদিনে ভালো। হয়ে যাবে।
মেয়ের যাওয়ার আগ্রহ দেখে তারা আর বাধা দিলেন না।
রোকেয়া রোকসানাকে নিয়ে শায়লার সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি চলে এল। বাড়িতে এসে শাশুড়ীকে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, আম্মা কেমন আছেন?
হানুফা বিবি রোকেয়ার কথার উত্তর না দিয়ে শায়লাকে বললেন, তুমি আনতে যাওনি বলে এতদিন আসেনি। বলেছিলাম না, সব আমার পায়ের তলে। কোনোদিন বাপের বাড়ির ভাত হজম হবে না। তুমি নিয়ে এলে কেন?
শায়লা বলল, আমি তো আনি নাই। রোকসানার মায়ের অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে সাথে চলে এল।
হানুফা বিবি বললেন, তোমরা সবাই সবাইয়ের কাছে ভালো থাকবে, আর মাঝখান থেকে আমি দোষী হব, তা হতে দিচ্ছি না। তাকে সাথে করে আনা তোমার উচিত হয়নি।
রোকেয়া খুব জ্বর ছিল বলে শাশুড়ীকে কদমবুনি করে রুমে এসে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। সে শায়লার কথা শুনতে পায়নি। কারণ শায়লা নিচু স্বরে কথা বলছিল। কিন্তু শাশুড়ী জোর গলায় কথা বলছিল বলে তার কথা শুনতে পেয়েছে। একসময় শায়লাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আম্মাকে কি এমন কথা বললে, যা শুনে তিনি ঐসব বললেন?
শায়লা শাশুড়ীকে যা বলেছিল, তা হুবহু বলল।
রোকেয়া খুব অবাক হয়ে বলল, এমন মিথ্যে কথা তুমি বলতে পারলে? তুমি আমাকে দেখতে গিয়ে একরকম বেঁধে নিয়ে এসেছ, আর আম্মাকে বললে, আমি নিজে। এসেছি?
শায়লা বলল, সত্য কথা বললে, আম্মা আমাকে গালি দিত এবং বাড়ির সবাই আমার বদনাম করত। তাই মিথ্যে করে বলেছি।
রোকেয়া বলল, তুমি যতটুকু লেখাপড়া করেছ, তার তুলনায় তোমার জ্ঞান একটুও হয়নি। তুমি যদি সত্য কথা বলতে, তাহলে আম্মা গালাগালি করলেও এ বাড়ির ও অন্যান্য বাড়ির সবাই তোমার সুনাম করত। সবাই তখন বলত, শাশুড়ী আনতে বারণ করা সত্ত্বেও জা-জাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তুমি তা না করে মিথ্যে বলে আমাকে সকলের কাছে অপমান করলে।
হানুফা বিবি এতক্ষণ আড়ি পেতে দুবৌয়ের কথা শুনছিলেন। এবার রুমে ঢুকে রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মেজ বৌ তোকে আনতে যায়নি, দেখতে গিয়েছিল।
রোকেয়া বলল, আমাকে আনতে যায়নি ঠিক কথা; কিন্তু ধরে আনতে গিয়ে বেঁধে এনেছে।
একথা শুনে হানুফা বিবি শায়লাকে গালাগালি দিতে লাগলেন।
এমন সময় শামসু ঘরে এসে শায়লাকে মা গালাগালি করছে শুনে মাকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আম্মা? তুমি শায়লাকে গালগালি করছ কেন?
হানুফা বিবি চিল্লে চিল্লে শায়লা কি করেছে বলল।
শামসু শুনে সেও শায়লাকে রাগারাগি করে গালাগালি দিতে লাগল।