বখতিয়ার কিছু বলতে যাচ্ছিল, রোকেয়া শাশুড়ীর হাত থেকে নিজের হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে বখতিয়ারের দুপা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মেজ ভাই, তোমার পায়ে ধরে বলছি, তুমি এখান থেকে যাও; আমি যাব না। এটা আমার স্বামীর ঘর। উনি আমার শাশুড়ী। ওঁকে কিছু বলার অধিকার তোমার নেই। আমাকে এরা তাড়িয়ে দিলেও আমি স্বামীর ঘর ছেড়ে যাব না। তুমি চলে যাও মেজ ভাই, চলে যাও। তারপর সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
বখতিয়ার বোনের ওপর রেগে গিয়ে বলল, তবে তুই এখানে পড়ে পড়ে মর, আমি চললাম। একথা বলে সে হন হন করে চলে গেল।
বাড়িতে এসে বখতিয়ার বাবা-মাকে রোকেয়ার শ্বশুর বাড়ির সব ঘটনা খুলে বলে বলল, তোমরা এমন ছোটলোকের বাড়িতে রেকের বিয়ে দিয়েছ, যেখানে সে জীবনে কোনোদিন সুখ-শান্তির মুখ দেখতে পাবে না। বাবারে বাবা, ওর শাশুড়ী যে এত জঘন্য মেয়ে যা দেখা তো দূরের কথা, কারো মুখে কোনোদিন শুনিনি।
ছেলের কথা শুনে মেহেরুন্নেসা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বিয়েটা তখন ভেঙে গিয়ে ভালোই হয়েছিল, কিন্তু….।
ভারাক্রান্ত মুখে শাহেদ আলী স্ত্রীর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি তকদিরে যা রেখেছেন তা হবেই। সেখানে কারো কিছু করার নেই।
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর শায়লার কোল আলো করে একটা ছেলে হল।
একদিন ঘরে তরিতরকারী কম ছিল। তাই রোকেয়া শাশুড়ীকে সেগুলো দেখিয়ে বলল, আজ ঘরে যা আছে তা দিয়ে চালিয়ে দিই আম্মা? কাল না হয় বাজারে পাঠাবেন।
হানুফা বিবি বললেন, বাবারে বাবা, এটা কোনোদিন আমরা পারব না। তোর বাপেরা গরিব। তোদের অভ্যাস আছে, তোরা করতে পারিস।
রোকেয়া মনে কষ্ট পেয়ে চুপ করে রইল।
যেদিন রোকেয়ার মেজ দেবরের ছেলের আকীকার অনুষ্ঠান হবে, সেদিন হঠাৎ করে হারুনের নানি সখিনা বিবি বললেন, আমি বাড়ি চলে যাব। উনি আগের থেকে এখানে আছেন।
হানুফা বিবি বললেন, কেন আম্মা, তুমি চলে যেতে চাচ্ছ? আজ শামসুর ছেলের আকীকার অনুষ্ঠান?
সখিনা বিবি রসিকতা করার জন্য বললেন, এখানে আর ভালো লাগছে না। তোদের বৌগুলো আমার সাথে কথা বলে না।
হানুফা বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, কোন বৌ তোমার সঙ্গে কথা বলে না?
সখিনা বিবির মুখ থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে এল, রোকসানার আম্মা।
হানুফা বিবি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, আমি আগেই জানতাম। আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন এলেই রোকসানার মা রিশ করে মুখ ভার করে থাকে। তারপর রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বল, তুই এমন করিস কেন? আমার আত্মীয়-স্বজনরা কি তোর বাপের খানা খায়? বল মাগী চুপ করে থাকিস না। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
সেখানে হানুফা বিবির এক চাচাতো জা ছিলেন। তিনি হানুফা বিবিকে বললেন, এসব তুমি কি বলছ হারুনের মা? তোমার আত্মীয়-স্বজন এলে রোকসানার মাকে তো কোনোদিন মুখ ভার করতে আমরা দেখিনি। এসব কথা তোমার মুখে সাজে না।
হানুফা বিবি বললেন, তোমরা আমার ঘরের খবর জানবে কি করে? যার যার ঘরের খবর সে-ই জানবে। তোমরা চুপ করে থাক। তারপর রোকেয়াকে বললেন, যা এবার তুই এখান থেকে চলে যা। আর তোকে আমি খাওয়াতে পারব না। তোর স্বামী আর টাকা পাঠায় না। তোদের মা-বেটির জন্য চুরি করতে যাব নাকি? যা, যা, চলে যা। এত বলি তবু যাস না কেন? তোর জন্য আমার মেজ বৌটাও খারাপ হয়ে গেল। তুই-ই তাকে খারাপ করেছিস? তোর জন্য আমার সোনার সংসার পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তুই যাবি কি না বল? এই বলে রোকেয়ার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলেন।
রোকেয়া এতদিন স্বামীর কথা স্মরণ করে শাশুড়ীর শত লাঞ্ছনা-গঞ্জনাসহ্য করে আসছিল। আজ আর পারল না। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আম্মা, আপনি আমাকে সব সময় যাতা বলে গালাগালি করেন। এমনকি আমার বাবা-মাকেও করেন। আমি অন্যায় না করলেও মিথ্যে অপবাদ দিয়ে গালাগালি করেন। কোনোদিন আমি প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আজ আর আমি চুপ করে থাকব না। আপনাকে বলতেই হবে, কেন আপনি শুধু শুধু আমার ওপর এত অত্যাচার করেন? আমার কি এমন অপরাধ?
হানুফা বিবি এমনি রেগে ছিলেন। তার উপর বৌয়ের সাহস দেখে আরো রেগে গিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন, তুই কে যে, তোর কথার উত্তর দিতে হবে? তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোকে আমার ভালো লাগে না। আর কোনোদিন লাগবে না। তোর পায়খানা দেখতে ইচ্ছা হয়, তবু তোর মুখ দেখতে ইচ্ছা করে না। এখন তুই আর কোনো কথা না বলে চলে যা। তোর ও তোর মেয়ের পেছনে কি কম টাকা খরচ হয়? আমাদের এতগুলোর চেয়ে তোদের মা-বেটির পেছনে বেশি খরচ হয়।
শাশুড়ী বৌয়ের মধ্যে যখন এসব কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে সখিনা বিবি, শায়লা, বদরুদ্দিন ও বাড়ির অন্যান্য সবাই এবং আশপাশের বাড়ির হারুনের কয়েকজন চাচি ও তাদের বৌয়েরা ছিলেন।
এত লোকের সামনে রোকেয়া অপমানিত হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল। বলল, আম্মা, আপনি আজ তিন বছর ধরে চলে যেতে বলছেন; কিন্তু কেন আমি যাব? আমি কি প্রেম করে আপনার ছেলেকে ভুলিয়ে বিয়ে করেছি? না পালিয়ে এসে তার সাথে বিয়ে বসেছি? যার জন্য এত জ্বালাচ্ছেন। মনে রাখবেন, আপনি যেমন পরের ঘরে এসেছেন, আমিও তেমনি পরের ঘরে এসেছি। এ ঘর যেমন আপনার বাবার নয়, তেমনি আমার বাবারও নয়। এটা যেমন আপনার স্বামীর ঘর, তেমনি আমারও স্বামীর ঘর। এখানে আপনার যেমন অধিকার আছে, তেমনি আমারও আছে। আমার অসুখের সময় আমার আম্মা একদিন আমাকে দেখতে এসেছিল। তার আগে-পরে কোনোদিন আসেনি। সেদিন এদিকে এক ডাক্তারের কাছে এসে আমার অসুখের কথা শুনে দেখতে এসেছিল। ঐদিন ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যাওয়ার পর আপনি বললেন, তোর মায়ের অসুখ বলল, নচেৎ ঝুটি ধরে কাজে লাগিয়ে দিতাম। সেদিন কেন আমার আম্মাকে এত বড় কথা বলেছিলেন? সে কি আপনার খায়, না পরে। আপনি পেয়েছেন কি? যেতে বললেই আমি চলে যাব? যাব না, দেখি আপনি কি করতে পারেন?