রূপার ভাগ্য খুব ভালো। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ী ও দেবর ননদেরা তাকে খুব ভালবাসে। তার স্বামীরা চার ভাই ও তিন বোন। সে-ই বাড়ির বড় বৌ। দুননদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট পড়াশুনা করছে।
রূপার যখন বিয়ে হয় তখন তার মেজ বোন রোকেয়া ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওদের বাড়ির সামনে দুটো পুকুর আছে। একটা ব্যবহার হয়। অন্যটা হয় না। সেটাতে শাপলা গাছে ভরা। একদিন দুপুরে রোকেয়া পাশের বাড়ির সমবয়সী মেয়ে নূরনাহারকে সাথে নিয়ে শাপলা তোলার জন্য পুকুরে নামল। কিনারেরগুলো তুলে একটু দূরে তুলতে গিয়ে দুজনেই ডুবে গেল। নূরনাহার সাঁতার জানত। সে সাঁতরে কিনারে এসে চিৎকার করে বলতে লাগল, রুকু তুই হাত উঠা।
রোকেয়া তখন ডুবে গিয়ে পানি খাচ্ছে। হঠাৎ নূরনাহারের কথা শুনতে পেয়ে হাত উঠাল। অমনি নূরনাহার রোকেয়ার হাত ধরে টেনে তুলে ফেলল। ততক্ষণে রোকেয়া বেশ খানিকটা পানি খেয়ে ফেলেছে। নূরনাহার পাড়ে উঠে রোকেয়াকেও ধরে উঠাল। আসলে পুকুরটায় পানি কম ছিল বলে এবং আল্লাহ পাক রোকেয়ার হায়াৎ রেখেছিল বলে সে যাত্রা বেঁচে গেল। এরপর থেকে রোকেয়া পানিকে ভীষণ ভয় করে। পুকুরে নেমে কোনোদিন আর গোসল করে না। পুকুর থেকে বালতিতে পানি তুলে পাড়ে গোসল করে। বৃষ্টির দিনে উঠোনে পানি জমে গেলে ভয়ে উঠোনেও নামে না। তাই দেখে অন্যান্য ভাইবোনেরা তাকে জোর করে উঠোনে নামায়। রোকেয়া তখন কান্নাকাটি করে। জাহেদ ও রূপা হেসে হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে বলে তুই যে এই সামান্য বৃষ্টির পানিকে এত ভয় করছিস, যখন বন্যা হবে তখন কি করবি? আমরা তো সাঁতার জানি। সাঁতার কেটে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেব। তুই তো সাঁতার জানিস না, ডুবে মরবি। এই কথায় রোকেয়া আরো কান্নাকাটি করে। শেষে মেহেরুন্নেসা তাদেরকে ধমক দিয়ে রোকেয়ার কান্না থামান।
রোকেয়া দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও সুন্দরী। পড়াশুনায় খুব ভালো। স্কুলে তাঁর অনেক বান্ধবী। ক্লাস সেভেনে উঠার পর লাকি নামে একটা মেয়ের সঙ্গে তার খুব ভাব হয়। তাদের বাড়ি রোকেয়াদের বাড়ির কাছাকাছি। মাত্র দুতিনিটে জমির পর। দুজনের গলায় গলায় ভাব। রাত ছাড়া সারাদিন এক সঙ্গে থাকে। কেউ কাউকে এক মিনিট না দেখে থাকতে পারে না। অসুখ বিসুখ হলে বা অন্য কোনো কারণে একজন স্কুলে না গেলে অন্যজনও যাবে না। একদিন রোকেয়া লাকিকে না বলে নানির বাড়ি গেল। সেদিন লাকি স্কুলে গেল না। পরের দিন রোকেয়া ফিরে এলে আঁশুভরা চোখে বলল, তুই আমাকে না বলে কোথাও যাবি না বল?
রোকেয়া তার চোখের আশু মুছে দিয়ে বলল, তুই আমাকে এত ভালবাসিস? আমারো কিন্তু নানির বাড়িতে তোর জন্য মন খারাপ হয়েছিল। তাইতো, নানি থাকতে বললেও থাকিনি।
লাকি বলল, আমার খুব ইচ্ছা হয়, তোকে সব সময় আমার কাছে রাখি। তোকে ছাড়া আমি একদম থাকতে পারি না।
রোকেয়া বলল, আমারো তোর মত ইচ্ছা হয়। আচ্ছা লাকি, এখন তো আমরা এক সাথে থাকি; কিন্তু যখন আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে তখন কি করব?
এক কাজ করব, তোর বা আমার যার আগে বিয়ে হবে, সে অন্যকে তার দেবরের জন্য নিয়ে যাব। তাহলে আর ছাড়াছাড়ি হবে না।
রোকেয়া হেসে উঠে বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু দেবর যদি না থাকে অথবা ছোট হয়, তখন কি হবে?
তাহলে যার আগে বিয়ে হবে, সে অন্যকে সতীন কর নিয়ে যাবে। তাহলে চিরজীবন এক সাথে থাকতে পারব।
কথাটা মন্দ বলিসনি। কিন্তু এক স্বামীর কাছে দুজনে এক সাথে থাকব কেমন করে?
কেন? স্বামীকে মাঝখানে রেখে দুজন দুপাশে থাকব।
তুই না বড় দুষ্ট হয়ে গেছিস।
এতে দুষ্ট হবার কি হল? আমরা দুজনেই যেমন স্বামীকে পেলাম তেমনি একসাথেও থাকলাম।
এখন এরকম বলছিস, কিন্তু তখন আর বলবি না। মেয়েদের সব থেকে বড় দুশমন হল সতীন। স্বামীকে একা পাওয়ার জন্য সতীনকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবি। জানিস না, মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে সতীনের জ্বালা সহ্য করতে পারে না?
তুই এসব জানলি কি করে?
আম্মা একদিন আব্বাকে বলছিল, তার এক খালাত বোন সতীনের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়ে মরে গেছে।
রোকেয়া বলল, তা হয়তো হবে।
এভাবে দিন গড়িয়ে চলল। রোকেয়া ও লাকি এখন ক্লাস টেনে পড়ছে। শাহেদ আলী আর কাতার যাননি। জাহেদকে নিয়ে গিয়ে চাকরি দেওয়ার দুতিন বছর পর থেকে তিনি বাড়িতেই আছেন।
একদিন রোকেয়া জ্বর নিয়ে স্কুল থেকে ফিরল। শাহেদ আলী ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাতে লাগলেন। কিন্তু জ্বর কমা যেমন তেমন বেড়েই চলল। শেষে শাহেদ আলী অন্য ডাক্তার আনলেন।
তিনি রোকেয়াকে পরীক্ষা করার পর আগের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে বললেন, রোগী ভাল হবে কি করে? আপনার মেয়ের টাইফয়েড হয়েছে, আর উনি ফোঁড়ার ওষুধ দিয়েছেন। তারপর প্রেসক্রিপশন করে বললেন, আগের ওষুধ খাওয়াবেন না, এগুলো এনে খাওয়ান।
এই অসুখে রোকেয়া প্রায় দেড়মাস ভুগল। সে সময় লাকি সারাদিন রোকেয়ার কাছে থেকেছে। অনেক দিন স্কুল ও কামাই করেছে। রোকেয়া স্কুলে যেতে বললেও যায়নি।
অসুখ ভালো হয়ে যাওয়ার মাস দুয়েক পর একদিন রোকেয়া জুলেখাকে নিয়ে বাকিলাহ বাজার নানার বাড়িতে বেড়াতে গেল। লাকিকেও আসার জন্য বলেছিল। তার মায়ের অসুখের জন্য আসতে পারল না।