আম্মার কাছে।
রোকেয়া রসিকতা করার জন্য হেসে উঠে বলল, হ্যাঁ,শায়লা করি। রোকসানার বাবা একটু অশিক্ষিত ছিল। তাই মারধর করে কিছু শিক্ষা দিয়েছি।
শায়লাও হেসে উঠে বলল, ধ্যাৎ, তুমি ইয়ার্কি করছ। আম্মা যখন বললেন, তখন যেমন বিশ্বাস করিনি, এখন তোমার কথাও তেমনি বিশ্বাস করিনি।
রোকেয়া হাসি থামিয়ে কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, কিছু বুঝতে পারছ?
শায়লা বলল, কি বুঝব বুবু?
রোকেয়া বলল, সেদিন তুমি বললে না, আমাদের দুজনের মিলমিশ আম্মা সহ্য করতে পারছেন না?
শায়লা বলল, হ্যাঁ, তা তো বলেছিলাম। কারণ তখন আমি তাই বুঝেছিলাম।
রোকেয়া বলল, তাহলে এখনো বোঝা উচিত ছিল, সেই মিলমিশ ছাড়াবার জন্য গুটির চাল চালাচ্ছেন।
শায়লা বলল, বুবু, তুমি ঠিক কথা বলেছ। এখন আমি বুঝতে পারলাম।
এর কিছুদিন পর হারুনের সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের খা হল। ধোয়ানীর দিন খুব বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথমে মিলাদ মাহফিল হবে। তারপর মেহমানদের খাওয়ান হবে।
রোকেয়া তখন বাপের বাড়িতে ছিল। শামসু একদিন দাওয়াত করতে এলে রোকেয়া তার সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করার পর আপ্যায়ন করাল।
আপ্যায়নের পর শামসু বলল, ভাবি, তালই সাহেব কি বাড়িতে নেই?
রোকেয়া বলল, সকালে মামা এসেছিল, আব্বা তার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। কোথায়, গেছে বলে যায়নি।
শামসু বলল, তাহলে মাওই সাহেবকে একটু ডেকে দাও।
রোকেয়া মায়ের কাছে গিয়ে বলল, তোমাকে আমার মেজ দেবর ডাকছে। মেহেরুন্নেসা মেয়ের সঙ্গে শামসুর কাছে এসে তাদের বাড়ির ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলেন।
শামসু সে সবের উত্তর দেওয়ার পর ছোট ভাইয়ের খানার অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
রোকেয়ার ছোট বোন জুলেখা সেখানে ছিল। শামসু চলে যাওয়ার পর রোকেয়াকে বলল, মেজ আপা, তোমার দেবর কই তোমাকে কিছু বলল না যে? তুমি কি যাবে?
রোকেয়া বলল, ভেবে দেখি কি করা যায়। তারপর চিন্তা করতে লাগল, আব্বা তো যাবেই না, কাউকে যেতেও দেবে না। আরো চিন্তা করল, আমার শাশুড়ী না হয় আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি; কিন্তু শায়লা শামসুর হাতে যাওয়ার কথা বলে দিল না কেন? আর শামসু নিজেও তো সেকথা বলতে পারত? ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, সে যাবে।
অনুষ্ঠানের দিন মা-বাবাকে বলে সে একটা স্কুটার করে শ্বশুর বাড়ি এল।
বাড়িতে পৌঁছাতেই হানুফা বিবি বললেন, তোকে তো আসতে বলিনি, তবু তুই এলি কেন? তোর মা-বাপকে দাওয়াত দিতে শামসুকে পাঠিয়েছিলাম। কিছু দেওয়ার ভয়ে বুঝি তারা না এসে তোকে পাঠিয়ে দিয়েছে?
বাড়ি ভরা মেহমানদের সামনে শাশুড়ীর কথা শুনে রোকেয়া অপমানে ও লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। মাথা হেট করে নিজের রুমে চলে গেল। রুমের ভেতর থেকে শুনতে পেল, শ্বাশুড়ী মেহমানদের বলছেন, আমার এ বৌটা খুব অপয়া। তাই এমন শুভ অনুষ্ঠান করার আগে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বেয়াই-বেয়ানকে দাওয়াত না দিলে লোকে মন্দ বলবে বলে তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলাম। তারা গরিব, খালি হাতে কি করে বড় লোকের অনুষ্ঠানে আসবে, তাই মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
শাশুড়ীর মুখে মেহমানদেরকে এসব কথা বলতে শুনে রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহকে জানাল, ইয়া আল্লাহ, এসব শোনার আগে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলে না কেন? তারপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে রোকেয়া সংসারের কাজে লেগে গেল।
অনুষ্ঠানের সময় যখন ছবি তোলা হচ্ছিল তখন হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, তুই এখান থেকে চলে যা, এদের সঙ্গে তোর ছবি তোলা যাবে না। এদের সঙ্গে ছবি তুললে সব নষ্ট হয়ে যাবে।
সমস্ত লোকজন ও মেহমানদের সামনে শাশুড়ীর কথা শুনে লজ্জায় ও মনের কষ্টে রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। সে আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়াল না। এরকম ছুটে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল। সারাদিন আর ঘর থেকে বের হল না। ভাবল, শায়লাও কি তাদের দলে ভিড়ে গেল? তা না হলে সে আমার হয়ে কিছু বলল না কেন?
অনুষ্ঠানের পরের দিন থেকে হানুফা বিবি রোকেয়াকে বাপের বাড়ি চল যাওয়ার জন্য বার বার তাগিদ দিতে লাগলেন।
একদিন রোকেয়ার মেজ ভাই বখতিয়ার বোনের বাড়ি এল। তার সামনে হানুফা বিবি রোকেয়ার হাত ধরে বের করে দেওয়ার সময় বললেন, যা এক্ষুণি তুই তোর ভাইয়ের সঙ্গে চলে যা। এখানে থাকলে তুই মেজ বৌকেও খারাপ করে ফেলবি। আজ তিন বছর ধরে তোকে চলে যেতে বলছি এবং কতবার ঘর থেকে বের করেও দিয়েছি, তবুও তুই যাসনি কেন?
বখতিয়ার এবছর বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছে। সে এর আগে মাত্র একবার এখানে এসে ঘণ্টাখানেক থেকে চলে গিয়েছিল। আজ দ্বিতীয় বার এসেছে। রোকেয়ার শাশুড়ী সম্পর্কে অনেক ভালো-মন্দ কথা সে শুনেছিল। এখন তার সামনেই বোনকে এরকম করতে ও বলতে দেখে যেমন অবাক হল তেমনি খুব রেগেও গেল। বলল, মাওই আম্মা, আপনি মানুষ না অন্য কিছু? তারপর রোকেয়াকে বলল, যা তোর মেয়েকে নিয়ে আয়। এক্ষুনি তোদেরকে নিয়ে যাব। তুই তোর শাশুড়ীর এত অত্যাচার সহ্য করে আছিস কি করে? শিগগির যা করতে বললাম কর।
হানুফা বিবি বখতিয়ারের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়লেন। এতদিন কোথায় ছিলে গো নবাবের বাচ্চা, বোনের হয়ে দরদ দেখাতে এসেছ। যাও নিয়ে যাও তোমার বোনকে। আর যেন এখানে না আসে। আমরা আমাদের ছেলের আবার বিয়ে দেব। মনে করেছ, তোমার বোন চলে গেলে আমরা ছেলের আর বিয়ে দিতে পারব না?