.
এবারে শামসু এসে বিয়ে করার কথা জানাল।
হানুফা বিবি মেয়ের সন্ধান নিয়ে একদিন শামসুকে বললেন, তোর ভাবিকে নিয়ে মেয়ে দেখে আয়।
শামসু বলল, ভাবির যাওয়ার দরকার নেই। আমি প্রথমে একা দেখে আসি। তারপর ভাবিসহ সবাই দেখে আসবে।
হানুফা বিবি তার কথা শুনলেন না। বৌকে ডেকে বললেন, তুই শামসুর সঙ্গে গিয়ে মেয়ে দেখে আয়।
রোকেয়া রান্নাঘর থেকে তাদের কথা শুনেছে। তাই বলল, যে বিয়ে করবে সে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে না, আমি যাব কি করে?
শামসু ততক্ষণে মেয়ে দেখতে চলে গেছে। তাই তখন হনুফা বিবি আর কিছু বললেন না। একদিন হনুফা বিবি বাড়ির সকলের সামনে বললেন, রোকসানার মায়ের মতো মেয়ে এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। তাকে কত করে বললাম মেয়ে দেখতে যেতে, সে দেমাগ করে গেল না। আমরা জানি, ভাবিরাই মেয়ে দেখে দেবরদের বিয়ে দেয়। আমাদের বৌটার পেটে খুব হিংসা।
রোকেয়া চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, আম্মা, আপনি যুক্তি ছাড়া কথা। বলেন। আপনি মেয়ে দেখতে যেতে বললেন, আর মেজভাই বলল, সে আগে একা মেয়ে দেখে পছন্দ হলে পরে আমরা যাব। তাহলে কেমন করে যাই আপনারাই বলুন।
হানুফা বিবি রেগে উঠে বললেন, আমাকে কি তুই এতই বোকা পেয়েছিস? আমি কি কিছু বুঝি না। তোর যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে শামসুর সঙ্গে জোর করে যেতে পারতিস।
রোকেয়া শাশুড়ীকে রেগে যেতে দেখে আর কিছু বলল না।
শামসু মেয়ে দেখে এসে পছন্দ হয়েছে বলার পর একদিন সবাই মিলে গিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে এল। কিন্তু রোকেয়াকে কেউ যেতে বলেনি বলে সে গেল না। কয়েকদিন পর রোকেয়া একদিন শামসুর ঘর পরিষ্কার করছিল। হনুফা বিবি সেখানে এসে ঝংকার দিয়ে বললেন, তোকে কে এসব করতে বলেছে? জা আসবে সেই হিংসাতে তাকে দেখতে গেলি না। এখন আবার তার ঘর পরিষ্কার করছিস। তারপর রোকেয়ার একটা হাত ধরে ঘর থেকে বের করে দিলেন।
রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেখান থেকে চলে এল।
বিয়ের দিন শামসু বৌ নিয়ে এলে বৌয়ের এবং তার সঙ্গে যারা এসেছে তাদের আদর আপ্যায়ন দেখে রোকেয়ার নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ল। সেদিন তার ও তার সঙ্গে যারা এসেছিল তাদেরকে কি রকম আদর আপ্যায়ন করেছিল, আর এদের কি রকম আদর আপ্যায়ন করা হচ্ছে। এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় রোকেয়ার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
শামসুর বৌ সায়লা খুব ভালো মেয়ে। দেখতে শুনতে যেমন, আচার ব্যবহারও তেমনি। দুএকদিনের মধ্যে রোকেয়ার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেল। দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করল। দুজায়ে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজকর্ম করতে লাগল।
একদিন শায়লা রোকেয়াকে বলল, তুমি আগে মরলে, তোমার পাশে আমার কবর দিতে বলব।
রোকেয়া মনে মনে খুব খুশি হয়ে ভাবল, আল্লাহ বুঝি এবার তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। জা যখন মনের মত হয়েছে তখন শাশুড়ী আর বেশি কিছু বলতে পারবে না। বলল, মরণ বাচনের কথা আল্লাহ জানেন।
মেজ জাকে নিয়ে রোকেয়া বেশ আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাতে লাগল। শাশুড়ী আর সংসারের দিকে ফিরেও তাকাননি। যা কিছু দুজায়ে মিলেমিশে করে। মাঝে মাঝে এক জা অন্য জাকে নিয়ে তাদের বাপের বাড়ি থেকে দুচার দিন করে বেড়িয়ে আসে।
কিন্তু যার তকদির খারাপ, তার কেউ ভালো করতে পারে না। কিছুদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পর হানুফা বিবি দুবৌয়ের মধ্যে এত মিলমিশ সহ্য করতে পারলেন না। মেজ বৌ শায়লার কাছে বড় বৌ রোকেয়ার অনেক বদনাম করতে শুরু করলেন।
শাশুড়ী যখন একদিন শায়লার কাছে রোকেয়ার নানারকম বদনাম করলেন, তখন সে চুপ করে শুনলো। তারপর সময় মতো রোকেয়ার কাছে এসে বলল, বুবু, আম্মা আজ আমার কাছে তোমার অনেক বদনাম করলেন। আমি সেসব বিশ্বাস করিনি। আমি জানি, সব মিথ্যে কথা। আসলে উনি আমাদের দুজনের মিল সুনজরে দেখতে পারছেন না এবং সহ্যও করতে পারছেন না। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আম্মা যা কিছু বলুক না কেন, আমরা দুজনে তার কথায় কান দেব না।
রোকেয়া বলল, আমি তোমার মতই একটা বোন চেয়েছিলাম! আল্লাহ মিলিয়েও দিয়েছেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাই।
এদিকে সবার অলক্ষ্যে রোকেয়ার ভাগ্য হাসছে। দুজায়ের এত ভাব থাকা সত্বেও এ সুখ শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হল না।
একদিন হানুফা বিবি শায়লাকে গোপনে বললেন, মেজ বৌ, রোকসানার মায়ের সাথে বেশি মেলামেশা করো না। তুমি এখন নতুন। তাকে চিনতে পারনি। সে খুব জঘন্য ধরনের মেয়ে। তোমার ভাসুরকে কতবার মেরেছে। তোমার ভাসুর খুব ভালো। বৌ ছেড়ে দিলে বংশের বদনাম হবে, তাই ওকে নিয়ে ঘর করছে। ওর সঙ্গে মিশলে তুমিও খারাপ হয়ে যাবে।
শায়লা শাশুড়ীর কথা শুনে খুব অবাক হয়ে বলল, আম্মা, এ আপনি কি বলছেন? মেয়ে মানুষ যতই খারাপ হোক, সে কোনোদিন স্বামীর গায়ে হাত তুলতে পারে না।
হানুফা বিবি বললেন, আমিও তো তাই জানতাম। কিন্তু রোকসানার মা খুব ছোট ঘরের মেয়ে। তার স্বভাব-চরিত্র আর কত ভালো হবে? তা না হলে স্বামীর গায়ে হাত তুলে! তাই তো তোমাকে সাবধান করে দিলাম।
শায়লা শাশুড়ীর কথা বিশ্বাস করতে পারল না। একসময় রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করল, বুবু, তুমি নাকি রোকসানার আব্বাকে মারধর কর?
রোকেয়া বলল, সেকথা পরে বলছি; আগে বল কার কাছে শুনেছ?