রোকেয়া প্রতিদিন শাশুড়ীর মুখে একই কথা শুনে স্বামীর উপদেশের কথা ভেবে এতদিন সহ্য করে আসছিল। কিন্তু আজ তাকে বাপ মা তুলে কথা বলতে শুনে আর সহ্য করতে পারল না। বলল, আম্মা, কেউ কাউকেই খাওয়াতে পারে না। খাওয়াবার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই সকল প্রাণীর রেযেকদাতা।
হানুফা বিবি রেগে গিয়ে তার একটা হাত ধরে গেটের বাইরে বের করে দিয়ে গেট বন্ধ করে বললেন, যা চলে যা, আর আসবি না।
রোকেয়া গেটের বাইরে বসে বসে কাঁদতে লাগল।
শেষে প্রায় ঘন্টা দুই পর রোকসানা যখন মায়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করতে লাগল তখন বদরুদ্দিন বৌমাকে ঘরে নিয়ে এলেন
দুতিন দিন পর রোকেয়া চাচি শাশুড়ীদের ও চাচাতো জায়েদের ডেকে বলল, আমার শাশুড়ী সব সময় আমাকে বাপের বাড়ি চলে যেতে বলেন, তবু আমি যাইনি। দুদিন আগে যে আমাকে উনি ঘর তেকে বের করে দিয়েছিলেন, আপনারাও জানেন? এখন আপনারাই বলুন আমি কি করব?
তাদের মধ্যে কেউ বললেন, আমরা কিছু বলতে পারব না। আবার কেউ বললেন, তোমার শাশুড়ী বললেও যাওয়া ঠিক হবে না। শুধু এক চাচাতো জা বলল, তুমি তোমার স্বামীর কাছে চিঠি দিয়ে জেনে নাও।
এর কয়েকদিন পর রোকেয়া রোকসানাকে নিয়ে একাই বাপের বাড়ি এল। তারপর মা বাবাকে বলল, আমি আর শ্বশুরবাড়ি যাব না। কারণ আজ দুবছর ধরে আমার শাশুড়ী আমাকে চলে আসতে বলছে। এমন কি একদিন ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।
সেদিন রোকেয়ার নানি রহিমন বিবিও মেয়ের বাড়ি এসেছেন। তিনি নাতনির কথা শুনে বললেন, তোর এখানে থাকা চলবে না। কয়েকদিন বেড়িয়ে চলে যা। আর কখনো হুট করে চলে আসবি না। তোর শাশুড়ী যতই তোকে বের করে দিক, তবু আসবি না। তুই দুয়ারে বসে থাকবি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি, শাশুড়ী বের করে দিয়েছে।
রোকেয়ার বাবা শাহেদ আলী বললেন, এবার যখন তোর শাশুড়ী চলে আসতে। বলবে তখন তাকে বলবি, আমার বাবাকে ডেকে এনে তারপর যেতে বলবেন।
সপ্তাহখানেক পর লোকের মুখে শাহেদ আলী খবর পেলেন, রোকেয়ার শাশুড়ীর কঠিন অসুখ। সে কথা বাড়ির সবাইকে জানিয়ে রোকেয়াকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
রোকেয়া চিন্তা করে রেখেছিল, হারুন বিদেশ থেকে ফিরে এসে নিয়ে না গেলে সেখানে যাবে না। কিন্তু মা বাবা যখন পাঠাতে চাইলেন তখন নিরুপায় হয়ে চলে এল। এসে দেখল, শাশুড়ীর ভীষণ অসুখ। চলাফেরা করতে পারেন না। রোকেয়া সংসারের সব কাজ করার সাথে সাথে শাশুড়ীর সেবা যত্ন করতে লাগল। অসুখ আরো বেড়ে যেতে হনুফা বিবিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু হাঁটা চলা করতে পারছেন না। তাকে ওষুধ খাওয়ান, গোসল করান ও ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, সব কিছু রোকেয়াকে করতে হচ্ছে।
মায়ের অসুখের কথা চিঠিতে জানতে পেরে হারুনের মেজভাই শামসু বিদেশ থেকে বাড়ি এল। যখন শামসু বাড়িতে ঢুকল তখন রোকেয়া শাশুড়ীকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধরতে এলে হানুফা বিবি বৌয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন, তোকে ধরতে হবে না, আমি যেতে পারি। তারপর তিনি বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শামসুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রোকেয়া শামসুকে আসতে দেখেনি। শাশুড়ীর দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে দেখল, শামসু আসছে। তখন সে বুঝতে পারল, কেন শাশুড়ী তাকে ধরতে দিল না। শামসুকে জানাতে চান, বৌ আমার সেবা যত্ন করে নি। এখন তাকে দেখে অভিনয় করছি। ততক্ষণে শামসু মাকে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, আম্মা, এখন তুমি কেমন আছ? তোমার অসুখের কথা জেনে চলে এলাম।
হানুফা বিবি ছেলের মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, এখন একটু ভালো আছি। তুই ঘরে যা, আমি বাথরুম থেকে আসছি। তারপর আস্তে আস্তে বাথরুমে গেলেন।
শামসু এবার রোকেয়াকে বলল, ভাবি কেমন আছ?
রোকেয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি।
শামসু জিজ্ঞেস করল, রোকসানা কোথায়?
রোকেয়া বলল, রুমে ঘুমোচ্ছে। তা তোমার ভাইয়া কেমন আছে?
শামসু হেসে উঠে বলল, ভাইয়া ভালো আছে। তোমার জন্য সন্দেশ পাঠিয়েছে। তারপর ব্যাগ খুলে মুখ আঁটা একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিল।
রোকেয়া চিঠিটা নিয়ে রুমে এসে পড়তে লাগল।
প্রিয়তমা রোকা,
পত্রে আমার আন্তরিক সবকিছু নিও। রোকসানাকে আমার আন্তরিক দোয়া ও স্নেহাশীষ দিও। আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি। তবে তোমার কথা ভেবে ভেবে বড় অশান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আল্লাহ কবে যে তোমাদের কাছে নিয়ে যাবেন, সে কথা তিনিই জানেন। তুমি ও রোকসানা কেমন আছ জানাবে। অনেক দিন তোমার পত্র না পেয়ে চিন্তিত আছি। পত্র দিয়ে চিন্তা দূর করো। আল্লাহপাকের দরবারে আমার জন্য দোয়া করো। আমি তাঁর দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করছি। আজ এই পর্যন্ত থাক। বেশি কিছু লিখতে মন চাইছে না। কারণ শামসু বাড়ি যাচ্ছে, আমারও যাওয়ার জন্য মন খুব ছটফট করছে। কিন্তু ছুটি পেলাম না বলে যেতে পারলাম না। তোমার নরম গালে ও ঠোঁটে কয়েকটা চুমো পাঠালাম, গ্রহণ করে এই হতভাগাকে ধন্য করো। আর পত্রে আমার জন্য তুমিও কিছু পাঠিও। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার হারুন।
এমন সময় রোকসানা ঘুম থেকে উঠে আম্মা আম্মা বলে কেঁদে উঠতে রোকেয়া চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে রোকসানাকে কোলে তুলে নিল।