রোকেয়া বলল, আমি আমার সুখ শান্তি চাই না, তোমাদের সুখ শান্তি চাই। তুমি তোমার বাবা মায়ের বড় ছেলে। তারা তোমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন। তোমার উপর তাদের কত আশা ভরসা। তুমি তাদের সুখী করার চেষ্টা কর। তাদের কথার অবাধ্য হয়ো না। আমাদের গ্রামে এক ওয়াজ মাহফিলে একজন আলেম ওয়াজ করার সময় বলেছিলেন, আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে আছে, হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইল (আঃ) এর স্ত্রীর কোনো দোষ দেখে তাকে পরিত্যাগ করতে বলেছিলেন। হযরত ইসমাইল (আঃ) পিতার কথামত সেই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। তুমিও যদি তাই কর, তাহলে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ দুনিয়াতে আমার চেয়ে কত সুন্দরী। মেয়ের ভাগ্য খারাপ রয়েছে। তাদের তুলনায় আমি অতি নগণ্য। আমি মনে করব, এটাই আমার তকৃদির।
হারুন রোকেয়ার কথা শুনে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল। অনেক রাতে যখন ফিরে এল তখন রোকেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। হারুন জানে, রোকেয়া না খেয়ে ঘুমিয়েছে। তাই সেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
এই ঘটনার দুদিন পর আজ হারুন বিদেশ চলে যাবে। গত দুদিন থেকে রোকেয়ার চোখ থেকে সব সময় পানি পড়ছে। কিছুতেই সামলাতে পারছে না। স্বামীর সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে রোকেয় কদমবুসি করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আমি তোমার এমন পাপী ও হতভাগী স্ত্রী যে, তোমাকে দুঃখ নিয়ে বিদেশ যেতে হচ্ছে। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।
হারুন তাকে বুকে চেপে ধরে বলল, রোকা প্রিয়তম আমার, আমিও তোমাকে অনেক দুঃখ দিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছি। আল্লাহপাক জানেন, আবার কবে তোমাদের মাঝে ফিরে আসব। তোমার দুঃখ কোনোদিন ঘোচাতে পাবর কি না তাও আল্লাহপাক জানেন। তুমি আমার উপর কোনো রকম মনে কষ্ট রেখ না। আমিও রাখব না! আমরা দুজনেই আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া চাইব, তিনি যেন আমাদেরকে সুখ-শান্তি দান করেন। তারপর গভীর আবেগে তার দুগাল চুমোয় চুয়ে ভরিয়ে দিতে রাগল।
রোকেয়াও চুপ করে থাকল না, সেও প্রতিদানে মেতে উঠল। রোকসানা এতক্ষণ খাটের উপর বসে মা-বাবার দিকে তাকিয়েছিল। সেদিকে হারুনের লক্ষ্য পড়তে স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, রোকা, মামণির দিকে খুব খেয়াল রাখবে। আর আম্মাকে যতটা সম্ভব খুশি রাখার চেষ্টা করবে।
এমন সময় হারুনের ছোট ভাই দরজার কাছে এসে বলল, স্কুটারওয়ালা তাড়াতাড়ি যেতে বলছে।
হারুন বলল, হ্যাঁ চল যাচ্ছি। তারপর রোকসানাকে রোকেয়ার কোলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে আব্বা আম্মাকে কদমবুসি করে আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আম্মা, তোমারে বৌকে দুমাস অন্তর বাপের বাড়ি পাঠিও।
হানুফা বিবি বললেন, ওসব আমি জানি না। তুই পারলে চিরকালের জন্য বৌকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে যা।
হারুন মেয়ের কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেলেও বিদেশ যাওয়ার সময় বলে প্রতিবাদ করল না। রোকেয়াকে বলল, তোমার যখন মন চাইবে তখন যেও। যে কদিন থাকতে মন চাইবে, সেই কদিন থেকে আবার নিজেই চলে এস। তারপর সে ব্রীফকেস হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে স্কুটারে উঠল।
৭-৮.দুবাই পৌঁছে চিঠি
০৭.
হারুন দুবাই পৌঁছে রোকেয়াকে চিঠি দিল।
রোকেয়া চিঠি পেয়ে পড়তে লাগল–
ওগো আমার প্রাণহরিণী,
কোন সুদূরে আছ তুমি? প্রথমেই তোমাকে জানাই আন্তরিক দোয়া ও ভালবাসা। আর তোমার নরম ঠোঁটে আমার গরম চুমো পাঠালাম। ঠাণ্ডা হতে দিও, কিন্তু তাড়াতাড়ি নিও। পরে স্নেহের পুতলী রোকসানাকে স্নেহ চুম্বন দিও। রোকা, সেদিন তোমাকে একা ফেলে রেখে আসতে আমার খুব খষ্ট হয়েছে। কেবলই মনে হচ্ছে, বিয়ের পর থেকে তোমাকে এতটুকু সুখ শান্তি দিতে পারি নি। শুধু দুঃখ দিয়েই চলেছি। শোন রোকা, আম্মা কিছু বললেই তুমি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দাও, এটা ঠিক নয়। লক্ষীটি খাওয়া। নিয়ে রাগ করো না। কারণ একদিকে যেমন তোমার শরীর নষ্ট হবে, অপরদিকে কেউ তোমাকে খেতে বলবে না। আমার কথা ভেবে শরীরের যত্ন নিও। আল্লাহপাকের কাছে কামনা করি, তুমি সুখে থাক, শান্তিতে থাক। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করো। রোকসানাকে চোখে চোখে রাখবে। পরিশেষে আল্লাহপাকের দরবারে তোমার কুশল কামনা করে এবং তোমার চিঠির আশায় থেকে শেষ করছি।
তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামী
হারুন।
চিঠি পড়ে রোকেয়ার মন বেদনায় ভরে গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চিন্তা করল, হারুন তুমি শুধু আমার রাগটা দেখলে; কিন্তু কেন রাগ করি সেটা জেনেও তার বিহিত করে গেলে না। তোমার মা যে উঠতে বসতে ঝগড়া করে, গালাগালি করে, মিথ্যে বদনাম দেয়, সে সব নিজের চোখে দেখে শুনেও আমাকে এখানে রেখে গেলে। আমি যে কি হালে এখানে থাকি তাও তুমি জান। তবু তার কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা করে গেলে না। এই সব চিন্তা করে রোকেয়া এখানকার ভালো-মন্দ খবর জানিয়ে সাদামাটা একটা চিঠি লিখে স্বামীর পত্রের উত্তর দিল।
এবারে হারুন চলে যাওয়ার পনের বিশ দিন পর একদিন হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, তুই এবার বাপের বাড়ি চলে যা। তোর জন্য আমার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তোর পাপের জন্য আমার ছেলেদের অসুখ লেগেই আছে, নচেৎ তাদেরকে বাঁচাতে পারব না। তুই আমার সংসার নষ্ট করেছিস। যা যা চলে যা, আর থাকিস না। এরকমভাবে প্রায় প্রতিদিন বলতে লাগলেন। আর একদিন বললেন, তোকে এত করে চলে যেতে বলি, যাস না কেন? তোর বাপ ভাই বোধহয় তোকে খাওয়াতে পারবে না। তাই বুঝি যেতে চাস না।