চার পাঁচদিন পর হারুন শ্বশুর বাড়ি এল।
রোকেয়া তাকে কদমবুসি করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হারুন তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, সেদিন তুমি হয়তো মনে খুব কষ্ট পেয়েছ। কিন্তু আমি মায়ের বিরুদ্ধে কি করতে পারি বল? তোমাকে পাঠিয়ে দিয়ে এই কদিন আমি যে কিভাবে কাটিয়েছি তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। তবুও আমার অন্যায় হয়েছে, সে জন্য মাফ চাইছি।
রোকেয়া চোখের পানি মুছে বলল, তোমার আর দোষ কি? সবই আমার কপাল। তুমি আমার কাছে মাফ চেয়ে আমাকে অপরাধী কর না।
হারুন বলল, রোকা, আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে না পেরে মাযের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। বল আমার সঙ্গে যাবে?
রোকেয়া বলল, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? বিয়ের পরে মেয়েদের স্বামীইতো সর্বস্ব। বাপ-মাও পর হয়ে যায়। তুমি নিয়ে যেতে এসেছ, আমি যাব না : কেন? নিশ্চয় যাব।
বিকেলে হারুন রোকেয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
রোকেয়া ঘরে ঢুকে প্রথমে শ্বশুরকে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, আব্বা কেমন আছেন।
বদরুদ্দিন বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, ভালো আছি মা।
তারপর রোকেয়া শ্বশুরের রুম থেকে বেরিয়ে এসে শাশুড়ীকে কদমবুসি করতে গেল।
হানুফা বিবি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে সকাল থেকে রেগে আছেন। রোকেয়া কদমবুসি করতে গেল পা সরিয়ে নিয়ে বেঁঝিয়ে উঠে বললেন, আমাকে ছুঁবি না। তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। তুই এখান থেকে চলে যা।
রোকেয়া মাথা নিচু করে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে স্বামীকে মায়ের কথা বলল।
হারুন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি মায়ের কথায় কিছু মনে করো না।
বিকেলে রোকেয়া রাত্রের জন্য রান্না করতে লাগল।
এদিকে হনুফা বিবি বারান্দায় পাটি বিছিয়ে একদল মেয়ে নিয়ে গল্প করতে বসেছেন। উনার এক জা, যিনি রোকেয়াকে দেখতে গিয়ে অপছন্দ করেছিলেন, তিনি একসময় বলরেন, হারুনের মা, তুমি ঐ বউয়ের হাতের রানা খাও কেমন করে? হারুনকে বলে দিও ওর হাতের রান্না খেলে পাপ হবে।
হানুফা বিবি বললেন, হ্যাঁ তুমি ঠিক কথা বলেছ। হারুন ঘরে এলে আজ তাকে বলব।
উনি আবার বললেন, এই বৌ দিয়ে তোমাদের সুখ শান্তি হবে না। হারুনকে বলল, সে যেন এই বৌকে ছেড়ে দেয়। কারণ সে তোমাদেরকে পছন্দ করে না। তোমাদের এত লোকেরা ঝামেলা ও সহ্য করতে পারছে না। সে যদি একমাত্র ছেলের বৌ হত তাহলে রান্না বান্নাও করত না। হোটেল থেকে কিনে এনে খেত।
রোকেয়া তাদের এইসব কথা শুনতে শুনতে রান্নার কাজ শেষ করল। তারপর পাশের বাড়ির এক চাচাতো জায়ের কাছে গিয়ে বসল। এই জায়ের সঙ্গে রোকেয়ার একটু ভাবসাব। মাঝে মধ্যেতার কাছে গিয়ে গল্প গুজব করে।
কিছুক্ষণ পরে হারুনকে ঘরে আসতে দেখে হানুফা বিবি চুলোয় কাঠ গুঁজে দিয়ে ধোয়া করে এসে তাকে বললেন। এবার তুই নিজের চোখে দেখ, তোর বৌ আগুনে ধোয়া দিয়ে চলে গেছে, ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেবে বলে। আমি কত করে তাকে বললাম, আমাদেরকে একটু চা করে দিতে। আমার কথার কোনো দাম দিল না। ওদের ঘরে গিয়ে গল্প করছে।
হারুন মায়ের কথা শুনে রোকেয়ার উপর খুব রেগে গেল। তার কাছে গিয়ে বলল, তোমার জন্য আমি এত কথা শুনি কেন? তুমি ঘরে আগুন লাগাবে বলে চুলোয় কাঠ দিয়ে এসে এখানে গল্প করছ?
রোকেয়া বলল, একথা তুমি বিশ্বাস করলে? তারপর তার শাশুড়ী ও চাচি শাশুড়ী যা বলেছিলেন সব হারুনকে বলল।
হারুন বলল, ঠিক আছে তুমি ঘরে চল।
রোকেয়া ঘরে এলে হনুফা বিবি বললেন, তোকে কত করে বললাম একটু চা করে দিতে। তুই দেমাগ করে চুলোয় ধোয়া দিয়ে চলে গেলি।
এই কথা শুনে রোকেয়া কান্নামান্না হয়ে বলল, আম্মা, আপনারা সবাই আমাকে নিয়ে যা তা করে বলছিলেন বলে আমি না শোনার জন্য চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু চুলোয় ধোয়া দিয়ে যাইনি। কারণ রান্না তো শেষ। আর আপনি চা দিতেও বলেননি। এটা একেবারে মিথ্যে কথা।
হানুফা বিবি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে চিৎকার করে বললেন, কি আমি মিথ্যে বলেছি? তোর এতবড় সাহস? তারপর হারুনকে বললেন, কিরে তোর সামনে আমাকে মিথ্যেবাদী বলল অথচ তুই চুপ করে আছিস? এই ধরনের মেয়েকে রীতিমতো পিটালে তবে সোজা হবে।
হারুন আসল ঘটনা বুঝতে পেরে চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল।
হানুফা বিবি সেই জাকে বললেন, দেখছ বুবু, হারুন কিছু বলল না। বলবে কি করে? ডাইনীটা আমার ছেলেকে তাবিজ করেছে। তা না হলে ছেলে হয়ে মায়ের অপমান সহ্য করে?
এর কয়েকদিন পর হারুন বিদেশ চলে যাবে। তাই একদিন সে রোকেয়াকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে সকলের সঙ্গে দেখা করতে এল। সেখানে একবেলা থেকে খাওয়া দাওয়া করে হারুন সবাইকে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে রোকেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই হানুফা বিবি হারুনকে বললেন, তোকে কতবার বলেছি। এই বৌকে নিয়ে কোনোদিন সুখ শান্তি পানি না। তুই এই একখানা বৌ নিয়ে এত পাগল হলি কেন? আবার বলছি ওকে ছেড়ে দে। আমি এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর দশখানা বৌ তোকে এনে দেব।
রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে হারুনকে বলল, এই সংসারে আমার সুখ শান্তি কোনোদিন হবে না। জানি না কপালে কি আছে?
হারুন তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, আম্মা যা কিছু বলুক না কেন, আমি তুমি ঠিক থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না। একথা আগেও অনেকবার বলেছি। এখন আবার তাই বলছি।