সকলের নাস্তা খাওয়া হয়ে যেতে রোকেয়া থালা-বাসন ধুয়ে রেখে রুমে এল। হারুন খায়নি বলে সেও খেল না।
তাকে দেখে হারুন বলল, আমি টিকিট কেটে নিয়ে আসি, আর থাকব না। আমার মন দিন দিন বিষিয়ে উঠছে। এই বলে সে বেরিয়ে যেতে উদ্দত হল।
রোকেয়া তার দুপা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওগো তুমি এখন যেও না। তুমি চলে গেলে আমি বুঝি শান্তি পাব? তুমি কয়েকদিন মাত্র বাড়িতে এসে আম্মার কাছে থাকতে পারছ না। আর আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কি করে তার সঙ্গে কাটাচ্ছি? কেন কাটাচ্ছি শুনবে? শুধু তোমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য। তা যদি না পাই, তাহলে আমি বাঁচব কোন আশায়?
হারুন তাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি রোকা, তোমাকে বিয়ে করে আমি মস্ত বড় অন্যায় করেছি। সে কথা ভেবে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।
রোকেয়া বলল, তুমি অপরাধী হতে যাবে কেন? তোমার ভালবাসায় কোনো খাদ নেই। সবই আমার তকৃদির। আমার তকদিরে যা লেখা আছে, তা তুমি শত চেষ্টা করেও দূর করতে পারবে না। আর কখনো নিজেকে অপরাধী ভাববে না বল?
হারুন তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, তোমার কথাই ঠিক। তকদিরে যা লেখা থাকে তা, কেউ বদলাতে পারে না।
সেদিন দুপুরেও আম্মার উপর রাগ করে দুজনে ভাত খেল না।
বিকেলে রোকেয়া ঘরদোর ঝাড় দিতে গেলে হনুফা বিবি তার হাত থেকে ঝাড় কেড়ে নিয়ে বললেন, তোকে আর কাজ করতে হবে না।
রোকেয়া আর কি করবে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চা-নাস্তা করতে গেল।
হানুফা বিবি ঝাড় দেওয়ার কাজ শেষ করে রান্না ঘরে এসে রোকেয়া এসব নাস্তা বানিয়েছিল, তা উঠোনে ফেলে দিয়ে নিজে বানাতে লাগলেন।
রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে রুমে এসে বসে রইল।
রাতে রান্না করতে গেলে হনুফা বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, তোকে কাজ করতে দিই না, তবু করতে আসিস কেন?
রোকেয়া চিন্তা করল, কথা বললেই শাশুড়ী আরো রেগে যা তা করে বলবে। তাই রুমে এসে শুয়ে শুয়ে কাদল।
হারুন ঘরেই আছে। সকাল থেকে সবকিছু দেখছে; কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। ভাবছে, ভালমন্দ কিছু বলতে গেলেই দুজনকেই আম্মা গালাগালি করবে।
হারুন মসজিদ থেকে মাগরিবের নামায পড়ে এসে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে বলল, কেঁদে আর কি করবে? কাজ যখন করতে দিচ্ছে না তখন করো না।
রোকেয়া বলল, কাজ না করলে খেতে যাব কোনমুখে?
তুমি তো ইচ্ছা করে কাজ করা বন্ধ করছ না? আম্মাই তোমাকে করতে দিচ্ছে না।
তবু কোন মুখে খেতে যাব?
হারুন আর কিছু না বলে চুপ করে বসে রইল। এশার আযান হতে রোকেয়া নামায পড়ার জন্য অজু করতে গেল।
হারুন নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গেল।
রোকেয়া নামাজ পড়ে বিছানায় বসে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করতে লাগল।
হারুন নামায পড়ে ফিরে এসে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল ভাত খেয়েছ?
না।
আম্মা খেতে ডাকেনি?
না।
হারুন আর কিছু না বলে তার পাশে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পরে হনুফা বিবি দরজার কাছে এসে বললেন, হারুন ভাত খাবি আয়।
সকাল থেকে রোকেয়া খায়নি বলে হারুন ও খায়নি। সে ইচ্ছে করলে হোটেলে খেতে পারত; কিন্তু রোকেয়াকে না খাইয়ে সেও খেতে পারেনি। আবার রোকেয়ার জন্য। হোটেল থেকে খাবার কিনে নিয়ে এলে, মা হুলস্থুল কাণ্ড করবে ভেবে আনেনি। এখন রোকেয়াকে না ডেকে শুধু তাকে খেতে ডাকছে শুনে মায়ের উপর প্রচণ্ড অভিমান হল। তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। সামলে নিয়ে বলল, তোমরা খেয়ে নাও, আমি খাব না।
হানুফা বিবি আর কিছু না বলে চলে গেলেন।
পরের দিন সকালে রোকেয়া কাজ করতে গেলে হনুফা বিবি বললেন, তোকে আর আমার সংসারে কোনো কাজ করতে হবে না।
জোর করে করতে গেলে যদি গালাগালি করেন সে কথা ভেবে রোকেয়া নিজ রুমে এসে বসে বসে প্রচণ্ড ক্ষিধের জ্বালায় চোখের পানি ফেলতে লাগল।
হারুন কিন্তু ঘরে নাস্তা খেল। তারপর বাইরে থেকে রুটি, কলা ও পেপসী কিনে এনে রোকেয়াকে খেতে বলল।
এভাবে এক সপ্তাহ চলল। হারুন ঘরে খাওয়া-দাওয়া করলেও রোকেয়াকে কেউ খেতে ডাকেনি এবং তাকে সংসারের কোনো কাজও করতে দেয়া হয়নি।
এই কদিন রোকেয়া এটা সেটা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। আটদিনের দিন হারুন বলল, তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও। এখানে থাকলে না খেয়ে মরে যাবে। শেষে আমাদের বদনাম হবে।
এই কথা শুনে রোকেয়ার মনে খুব আঘাত লাগল। চোখের পানিতে বুক ভাসাতে ভাসাতে বলল, বেশ তুমি যা চাও তাই হবে।
ঐদিন হারুন একটা স্কুটার এনে রোকেয়াকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
রোকেয়ার মনে হল, এর চেয়ে তার মরণ ভালো ছিল। যেতে যেতে ভাবল, আমি হারুনের জন্য না খেয়ে এতদিন কাটালাম, তার সে কিনা তার কোনো প্রতিকার না করে উল্টো আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল? এই জন্য কথায় বলে, যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর।
বাপের বাড়ি পৌঁছাতে সকলে রোকেয়ার শরীরের অবস্থা দেখে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগল।
রোকেয়া তাদেরকে তার অসুস্থতার কথা জানাল।
মেহেরুন্নেসা এক সময় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, আসল ঘটনা কি হয়েছে বলতো।
রোকেয়া মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর শ্বশুর বাড়িতে যা ঘটেছে তা সব খুলে বলল।
মেয়ের কথা শুনে মেহেরুন্নেসা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, করার কিছু নেই। সবর কর মা, একদিন না একদিন আল্লাহ তার ফল দেবেন। জানিস তো, সবরের গাছ খুব তিতা, কিন্তু ফল খুব মিষ্টি।