হানুফা বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, তুই বৌয়ের হয়ে এত যে শাউকড়ি করছিস, ঘরের কাজ কে করবে শুনি?
হারুন বলল, তোমাদের শুধু কাজ আর কাজ। সে তো তোমার কথামত সংসারের সব কাজই করে। আজও সব কাজ সেরে দিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের বৌ তো যেতেই চায় না। আমি তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।
হানুফা বিবি এই কথার জবাব দিতে না পেরে আরো রেগে গিয়ে বললেন, দেখ হারুন, আমাকে বেশি রাগাবি না।যা, যেখানে তোদের মন চায় যা। দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।
হারুন, চুপচাপ ফিরে এসে রোকেয়া ও রোকসানাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুল।
বদরুদ্দিন এখন বেশ সুস্থ। তিনি সুস্থ অবস্থায় বা অসুস্থ অবস্থায় ছেলে বৌ কিংবা সংসার নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামান নি। আজ ছেলে বৌ বেড়াতে বেরিয়ে যাবার পর স্ত্রীকে বললেন, ওরা আজকালের ছেলেমেয়ে, একটু আধটু বেড়িয়ে ফুর্তি করবে। তাছাড়া এটাই তো ঐসব করার বয়স। তাতে তুমি বাধা দিতে যাও কেন?
হানুফা বিবি বেশ অবাক হয়ে স্বামীর দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, কি ব্যাপার? তুমিতো কোনোদিন সংসারের কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাওনি। আজ যে হঠাৎ ছেলে বৌয়ের জন্য দরদ উথলে উঠল? ঐ সর্বনাশী মেয়েটা হারুনকে। শেষ করে দিচ্ছে। তা দেখতে পাওনি? আমার ছেলের কিছু হলে, আমিও বলে রাখছি, ওকেও আমি শেষ করে দেব। তুমি এসব নিয়ে আর কোনোদিন কথা বলবে না।
বদরুদ্দিন স্ত্রীকে ভালভাবেই চেনেন। সে যে নিজের গায়ে চিরকাল চলে এসেছে তা। জানেন। বিয়ের পর প্রথম প্রথম স্ত্রীর এই খুঁয়েমীর জন্য মারধর করতেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। হানুফা বিবির গ আরো বেড়ে গেছে। তাই তিনি স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্ক রাখেন নি। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক তা কোনোদিন ছিল না। আর আজও নেই। হানুফা বিবি নীরেট মুখ। তিনি মধুর সম্পর্ক। টম্পর্ক কি নিজে যেমন জানেন না, তেমনি অন্য কারোদেরে যে থাকতে পারে তাও জানেন না। তাকে বদরুদ্দিন কোনোদিন কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাননি। তাই ছেলে বৌকে বেড়াতে নিয়ে গেলে রেগে যান। এখন তাদের হয়ে স্বামীকে ঐ কথা বলতে শুনে তিনি তাকে ঐসব বললেন। আর বদরুদ্দিন ও তাই স্ত্রীর কথা শুনে চুপ করে গেলেন।
.
০৬.
এই ঘটনার কয়েকদিন পর বদরুদ্দিন আজ মিলাদ পড়াবার আয়োজন করেছেন। মিলাদ শেষ হতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। তখনো কারো খাওয়া-দাওয়া হয়নি। হঠাৎ রোকেয়া মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
তার ছোট দুটো দেবর দেখতে পেয়ে কাছে এসে বলল, ভাবি, তোমার কি হয়েছে? অমন করে পড়ে গেল কেন?
রোকেয়া কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বলল, কি জানি, হঠাৎ মাথাটা ঘুরে যেতে পড়ে গেলাম। তারপর উঠে আস্তে আস্তে ঘরে গিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ল।
হানুফা বিবি বৌকে পড়ে যেতে দেখেছেন; কিন্তু কাছে আসেননি। তাকে শুয়ে। থাকতে দেখে বললেন, ভাত না খেয়ে ঘুম যাচ্ছিস কেন? সারাদিন তো একটা কাজও করিসনি। তবু ভাত খেতে সময় পেলি না।
রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবল, সারাদিনএকটু বসবারও সময় পেলাম না, আর উনি বললেন কিনা, একটা কাজও করিনি। তখন তার মনে খুব কষ্ট হল। আজ আর ভাত খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল। আবার চিন্তা করল, ঘরে অনেক মেহমান, ভাত না খেলে শাশুড়ী আবার হয়তো গালাগালি শুরু করে দেবেন। তাই উঠে এসে ভাত খেল।
পরের দিন সকালে মেহমানরা সব চলে গেলেন। শুধু হারুনের নানি রয়ে গেলেন। রোকেয়া নাস্তা বানিয়ে সবাইকে খেতে দিল।
হারুনের সেজ ভাই মজিদ তার ডিমের সাথে খোসা লেগে রয়েছে দেখে রেগেমেগে রোকেয়াকে বলল, ভাবি, তুমি বাপের বাড়িতে কাজ করতে করতে হাতের চামড়া খুইয়ে। ফেলছ, আর এখানে এসে চালতা বেচনি হয়ে দোলনায় চড়েছ।
রোকেয়া অবাক হয়ে বলল, মজিদ ভাই, হঠাৎ তুমি আমাকে একথা বললে কেন?
মজিদ বলল,আহা দুধের বাচ্চা, কিছুই জানে না। তারপর ডিমটা দেখিয়ে বলল, এই যে ডিমের সাথে খোসা লেগে রয়েছে দেখতে পাওনি বুঝি?
রোকেয়া বলল, তুমি না জেনে এ রকম কথা আমাকে বলতে পারলে? ডিম নানি ছাড়িয়েছে।
মজিদ মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, দেখলে আম্মা, বেটীকে চাই দিয়েও ধারা যাচ্ছে না। কেমন কথার কাটান দিচ্ছে? ভাবি দিন দিন মুখরা হয়ে উঠছে।
হানুফা বিবি ঝংকার দিয়ে বলল, হবে না? তোর বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে এ রকম হচ্ছে। তারপর রোকেয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই বেটী, চুপ করে থাকবি। কথা। বললে ঠোঁট সেলাই করে দেব।
এতক্ষণে হারুনের নানি বললেন, তোমরা একি কাণ্ড শুরু করলে? ডিমগুলো আমি পরিস্কার করেছি। তোমাদের বৌ তখন অন্য কাজ করছিল।
হানুফা বিবি বললেন, আম্মা, তুমি আবার আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ কেন? এসব তুমি কিছু বুঝবে না।
হারুন সেখানে নাস্তা খেতে এসেছে। ছোট ভাইয়ের কথা শুনে প্রথমে মনে করেছিল, রোকেয়ার দোষের জন্য ছেলে মানুষি বুদ্ধিতে সে ঐ রকম বলে ফেলেছে। তবু রেগে গিয়েও চুপ করেছিল। তারপর রোকেয়া ডিম ছাড়ইনি বলা সত্ত্বেও মজিদ ও মা যখন রোকেয়াকে ঐ সব বলল, তখন তাদের উপর অত্যন্ত রেগে গিয়ে বলতে গিয়েও থেমে গেল। চিন্তা করল, কিছু বলতে গেলেই কেলেংকারীর সৃষ্টি হবে। তাই রাগ দমন করার জন্য না খেয়ে রুমে চলে গেল।