রোকেয়া শুনে লজ্জা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেল।
হারুন বাড়িতে আসার কয়েক দিন পর একদিন মাকে বলল, আজ তোমাদের বৌকে নিয়ে একটু বেড়াতে যাব।
হানুফা বিবি রেগে গিয়ে বললেন, তাহলে সংসারের কাজ করবে কে? আমাকে কি তোরা বাদী পেয়েছিস নাকি? আমি কোনো কাজ করতে পারব না।
হারুন বলল, তুমি এমন কথা বলছ কেন আম্মা? তুমি কাজ করতে যাবে কেন? তোমাদের বৌ সব কাজ করে দিয়ে যাবে।
হানুফা বিবি আর কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
হারুন রোকেয়াকে বলল, তুমি চটপট সব কাজ সেরে ফেলে তৈরি হয়ে নাও, আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।
রোকেয়া তখন চিন্তা করল, বেড়াতে না যাওয়াই ভালো। গেলে শাশুড়ী আজ আবার অনেক কথা শোনাবে। আবার ভাবল, স্বামীর কথা না শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হারুন বলল, রোকা, তুমি আমার কথা শুনবে না?
রোকেয়া চিন্তা করে ঠিক করল, শাশুড়ীর বকুনি খাবে সেও ভালো, তবু স্বামীর মনে কষ্ট দেবে না। বলল, ঠিক আছে, তুমি কোথায় যাবে বলছিলে যাও। আমি ততক্ষণে কাজ সেরে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
সেদিন হারুন একটা স্কুটার ভাড়া করে রোকেয়াকে নিয়ে প্রথমে বদরপুরে শ্বশুর বাড়ি গেল। শ্বশুর শাশুড়ীকে সালাম করে কুশল বিনিময় করল। তারপর নাস্তাপানি খেয়ে ছোট শালা বাহাদুরকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদপুর টাউনে এল। মার্কেট ঘুরে ঘুরে হারুন মায়ের ও স্ত্রী জন্য দুটো শাড়ী ও দুটো ব্লাউজ এবং দুজোড়া জুতো, আব্বার জন্য একটা লুঙ্গী ও পাঞ্জাবী, রোকসানার দুসেট জামা ও জুতো, ছোট ভাইদের ও বাহাদুরের জন্যে একটা করে প্যান্ট ও শার্টের পীস এবং জুলেখার জন্য থ্রিও পীস কিনল। তারপর ভাত খাওয়ার জন্য একটা হোটেলে ঢুকল।
খাওয়ার শেষ পর্যায়ে বাহাদুর বলল, দুলাভাই, আইসক্রীম খাওয়াতে হবে। হারুন মেসিয়ারকে ডেকে চারটে পোলার দিতে বলল।
রোকেয়া মেসিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল, না না তিনটে দিন। তারপর স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, চারটে কি হবে? রোকসানা আইসক্রীম খেতে পারবে না। যদি খায় আমার থেকে খাওয়াব।
খাওয়া-দাওয়ার পর তারা বাড়ি রওয়ানা দিল। ফেরার পথে প্রথমে শ্বশুর বাড়িতে এল। জুলেখা থ্রিপীস দেখে মহাখুশী। মেহেরুন্নেসা মেয়ে জামাইকে থেকে যেতে বললেন।
হারুন ও রোকেয়া কিছুতেই রাজি হল না।
মেহেরুন্নেসা বললেন, তাহলে রাতে খাওয়া-দাওয়া করে যাও।
রোকেয়া জানে, এমনি শাশুড়ীতে আসতে দিতে চেয়েছিল না। তার উপর রাত। করে বাড়ি ফিরলে কিছু বলতে বাকি রাখবে না। সেই কথা ভেবে বলল, না আম্মা, আমাদেরকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে। তারপর মিথ্যে করে বলল, তোমার জামাইয়ের কাছে আজ সন্ধ্যের সময় কয়েকজন লোক দেখা করতে আসবে।
মেহেরুন্নেসা বললেন, তাহলে তোদেরকে তো আটকাতে পারি না। তারপর জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা একটু জিরিয়ে নাও। আমি নাস্তা তৈরি করে নিয়ে আসি।
নাস্তা খেয়ে তারা যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যে।
হানুফা বিবি তোদেরকে দেখে চিৎকার করে হারুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মাকে বাঁদীগিরী করতে দিয়ে বৌ নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে ফুর্তি আমোদ করে এলি। আল্লাহ-এর বিচার করবে।
হারুন মায়ের কথায় রাগ করল না। মাকে খুশি করার জন্য বলল, আম্মা, তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। সংসারে কাজ করলে কেউ বাদী হয় না। বরং বাদীগিরী করার জন্য রোকেয়াকে বিয়ে করে এনেছি। তারপর মায়ের হাত ধরে ঘরে এনে তার, আব্বার ও ভাইদের কাপড়-চোপড় ও জুতো যা কিছু কিনে এনেছে, সেগুলোর প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল, দেখ দেখি এগুলো তোমার পছন্দ হয় কি না?
হানুফা বিবি একটা একটা সবগুলো দেখে খুশি হলেন। বললেন, রোকসানা ও তার মায়ের জন্য কিছু কিনিসনি?
হারুন বলল, হ্যাঁ কিনেছি। তারপর সেগুলোও খুলে দেখাল।
হানুফা বিবি আর কিছু না বলে কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে গেলেন।
এইভাবে চার পাঁচ মাস পার হয়ে গেল। এবার হারুন বিদেশ চলে যাবে। তাই একদিন রোকেয়াকে বলল, আজ বেড়াতে যাব। তুমি ঘরের সব কাজ এমন ভাবে-করে ফেলবে, আম্মা যেন কিছু বলতে না পারে।
রোকেয়া সংসারে সব কাজ ঠিকমত করে বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি হল। হানুফা। বিবি তা জানতে পেরে ভীষণ মুখ খারাপ করে গালাগালি করতে করতে বললেন, এমন ছোটলোকের মেয়ে জীবনে দেখিনি। লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই। স্বামীকে যাদু করে চুষে খেয়ে ফেলতে চায়। তাকে ভেড়া বানিয়ে বাইরে নিয়ে ফুর্তি করে। ঘরে ফুর্তি করে পোষায় না। হস্তিনী মেয়েরা এই রকম হয়। এই মেয়ে আমার ছেলেকে শেষ না করে। ছাড়বে না। এ রকম যে করবে তা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তখন বৌ করতে অমত করে ছিলাম। এখন আমার ঘাড়ে সংসারের কাজ ফেলে দিয়ে স্বামীকে নিয়ে নবাবের বেটী ফুর্তি করতে বেরোচ্ছে।
হানুফা বিবি যখন এইসব বলছিলেন তখন হারুন ও রোকেয়া নিজেদের রুমে ছিল। রোকেয়া স্বামীকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, প্রিয়তম তুমি রাগ করো না, আজ আমি বেড়াতে যাব না।
হারুন এতক্ষণ মায়ের কথা শুনে খুব রেগে গিয়েছিল। এতদিন তার অনেক কথা সহ্য করতে পারলেও আজ পারল না। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আম্মা, তুমি এসব কি শুরু করলে বলতো? রোকেয়াকে কি পেয়েছ? সব সময় এরকম করলে সে এখানে টিকবে কি করে? তুমি যে ওকে এভাবে বলছ, ওতো এখন এ বাড়ির বড় বৌ, এরকম করে বললে আমাদের বংশের ইজ্জত যাবে না?