হানুফা বিবির চিৎকারে বাড়ির সবাই সেখানে এল। রোকেয়াকে দেখে হানুফা বিবি বললেন, তুই আমার বাপকে মেরে ফেলেছিস। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাই না।
রোকেয়া নানা শ্বাশুর মারা গেছে শুনে ভীষণ দুঃখ পেয়ে কাঁদছিল। আর ভাবছিল, এ বাড়ির মধ্যে সব থেকে বেশি যিনি আমাকে ভালবাসতেন, তাকে আল্লাহপাক তুলে নিলেন। দীলে দীলে তাঁর রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করছিল। শ্বাশুড়ীর কথা শুনে আরো বেশি দুঃখ পেয়ে চিন্তা করল, হায়রে মানুষের মূর্খতা? ওঁর পেটে যদি এলেম থাকত, তাহলে এ রকম কথা বলাতো দূরের কথা, এরকম ভাবতেও পারতেন না। তখন তার একটা হাদিসের কথা মনে পড়ল, তালিবুল এলেম ফরিদাতুন আলা কুলে মুসলিমিন অর্থাৎ মুসলমান নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন ফরয।
ততক্ষণে খবর পেয়ে আশেপাশের বাড়ির মেয়ে পুরুষ অনেকে এসেছে তারা হানুফা বিবির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। তাদের মধ্যে ওর এক চাচাতো বড় জা বললেন, হারুনের মা, তুমি একি কথা বলছ?ইনার মৃত্যু আল্লাহপাকের হুকুমে হয়েছে। তুমি শুধু শুধু বৌকে দোষারূপ করছ? কারুর মৃত্যুর জন্য কাউকে এভাবে দায়ী করা ঠিক নয়। যখন দুচারজন এসব বলতে নিষেধ করল তখন বৌকে দোষারূপ করা থেকে বিরত হলেন।
আনসার উদ্দিন মারা যাওয়ার ষোল সতের দিন পর রোকেয়া একটা মেয়ে প্রসব করল। বাড়ির সবাই খুশি হয়ে বলাবলি করতে লাগল, এই বাড়িতে প্রায় ত্রিশ বছর পর আল্লাহ মেয়ে দিল। আমাদের বাড়িতে কোনো মেয়ে ছিল না যে, একটু আদর করব। কিন্তু হানুফা বিবি খুশি হতে পারলেন না। বললেন, এতদিন মেয়ে হয়নি ভালই ছিল। মেয়ে বিয়ে দিতে যখন মোটা টাকা খরচ হবে তখন কত ধানে কত চাল বুঝবে। ওঁর কথার কেউ কান দিল না।
আকিকার দিন সবাই নাম রাখল রুকসানা বেগম।
রুকসানা যখন দুমাসের তখন হারুনের মেজ ভাই শামসু বিদেশ থেকে এল। সে ভাইজী হয়েছে জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হল।
রোকেয়াকে দেখে এবং তার ব্যবহারে শামসু খুব সন্তুষ্ট। তাকে বলল, তোমার মত ভাবি পেয়ে আমি ধন্য। চিঠিতে যখন ভাইয়ার বিয়ের কথা জানতে পারলাম তখন মনে মনে তোমার মতো ভাবিই আশা করেছিলাম।
রোকেয়া বলল, আমিও তোমার মতো দেবর পেয়ে ধন্য হলাম। এখন বলত ভাই, আমি তো তেমন সুন্দরী নই, তবু কেন আমাকে তোমার ভালো লাগল?
শামসূ বলল, কে বলেছে তুমি সুন্দরী নও। শুধু গায়ের চামড়া সাদা হলেই কেউ সুন্দরী হয় না। সুন্দরী হওয়ার জন্য সাদা রং ছাড়া আর যেসমস্ত জিনিসগুলো দরকার, তা তোমার মধ্যে বিদ্যমান। তার উপর তোমার গুণাবলী তোমাকে আরো সুন্দরী করে তুলেছে।তাই তো নানাভাই তোমাকে অত ভালবাসতেন। তিনি যে রকম রসিক ছিলেন, তুমিও সেইরূপ রসিক। নানাভাইকে জীবিত দেখতে পেলাম না, এটাই যা দুঃখ। তার মতো রসিক মানুষ জীবনে দেখিনি। তারপর রোকসানাকে আদর করতে করতে বলল, মামণি তুমিও তোমার মায়ের মতো গুণবতী হও, এই দোয়া করি।
শামসু আসার প্রায় পাঁচ ছ মাস পর হারুন হঠাৎ বিদেশ থেকে এল।
রোকেয়া তখন যোহরের নামায পড়ছিল। নামাযের মধ্যে স্বামীর আগমন টের পেল। নামায শেষ করে রুমে গিয়ে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?
হারুন সালামের জবাব দিয়ে স্ত্রীকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে রইল। তারপর দুগালে অসংখ্য চুমো খেয়ে বলল, এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি সত্যি তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাচ্ছি কি না?
রোকেয়াও চুমোর প্রতিদান দিয়ে বুকে মাথা রেখে বলল, হ্যাঁ গো সত্যি। নামায। পড়ার সময় তোমার আসার খবর টের পেয়ে দুরাকায়াত শোকরানার নামায পড়েছি। তুমি একটু ছাড়, রোকসানাকে নিয়ে আসি।
হারুন তাকে আবার কয়েকটা চুমো খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও তাড়াতাড়ি নিয়ে এস।
রোকেয়া রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দোলনা তেকে ঘুমন্ত রোকসানাকে নিয়ে ফিরে এল। তারপর স্বামীর কোলে দেওয়ার সময় বলল, এই নাও তোমার মেয়ে রোকসানা। আল্লাহপাক আমার মনের বাসনা পূরণ করে মেয়ে দিয়েছেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে শুকরিয়া জানিয়েছি।
হারুন মেয়েকে চুমো খেয়ে আদর করতে করতে বলল, রোকা, তুমি আমাকে হারিয়ে দিলে। তবে হেরে গিয়েও খুব আনন্দ লাগছে। কারণ আমাদের বাড়িতে কোনো ছিল না।
রোকসানা জেগে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে দিল। এক বছরের মেয়ে কিছু বলতে পারছে না। এক সময় আম্মু বলে রোকেয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে ভ্যা করে কেঁদে উঠল।
রোকেয়া কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, কাঁদছ কেন আম্মু, তোমার আব্দুকে চিনতে পারছ না? রোকসানার কান্না থেমে যেতে স্বামীকে বলল, চল খেতে চল।
হানুফা বিবি প্রথম থেকেই ছেলে বৌকে এক সাথে বেশিক্ষণ থাকা পছন্দ করেন না। তাই হারুন ঘরে থাকলে রোকেয়া যখন কাছে আসত তখন বড় গলায় বলতে থাকেন, দিনের বেলা স্বামী ঘরে এলেই তার কাছে যেতে হবে নাকি? এমন নির্লজ্জ মেয়ে কখনো দেখিনি। এদিকে সংসারের কাজ ওল ওল, ভ্যান ভ্যান করছে। সে সব করবে কে?
প্রথম প্রথম রোকেয়া এই কথা শুনে লজ্জায় বাঁচত না। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসত। পরে দিনের বেলা হারুন ঘরে থাকলে হঠাতে আসত না।
একদিন হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, তুই সকালে গোসল করতে এইদিক দিয়ে যাবি না। তোর নাপাক দৃষ্টি আমার ছেলেদের উপর পড়ে। তাই তাদের অসুখ লেগেই থাকে। তোকে এনে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তুই অপয়া সর্বনাশী মেয়ে।