জাহেদ এইচ. এস. সি. পাশ করার পর শাহেদ আলী ছেলেকেও কাতারে নিয়ে চলে গেলেন। তিনি এতদিন কাতারে গিয়ে সংসারের অনেক উন্নতি করেছেন। ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার পর দিন দিন তাদের আরো উন্নতি হতে লাগল।
জাহেদের পরেই কুলসুম। ডাক নাম রূপা। রূপা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন একজন ঘটক তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। শাহেদ আলী কয়েকদিন আগে কাতার থেকে দেশে ফিরেছেন। তিনি এত ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। ঘটককে বললেন, আমার মেয়ে-ছোট। তাছাড়া মেয়েকে আমি এস.এস.সি. পর্যন্ত অন্তত পড়াব। তারপর বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করব।
বাকিলাহ গ্রামেই ঘটকের বাড়ি। শাহেদ আলী ও তার শ্বশুর জয়নুদ্দিনকে ভালভাবে চেনে। এই কাজ করাতে পারলে তাদের কাছ থেকে মোটা বখশিস যে পাওয়া যাবে, তা সে খুব ভালভাবে জানে। তাই শাহেদ আলীকে রাজি করাতে না পেরে তার শাশুড়ী রহিমন বিবি ও শ্বশুর জয়নুদ্দিনকে গিয়ে ধরল। পাত্রেরও পাত্রের বাবার অবস্থা এবং তাদের বাড়ির সকলের গুণাগুণ করে বলল, পাত্র শিক্ষিত। ইরাকে চাকরি করে। দেখতে শুনতে খুব ভালো। তারপর নানারকম চাল খেলে তাদের মন জয় করে ফেলল। রহিমন বিবি ও জয়নুদ্দিন সাবেক কালের মানুষ। তারা মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিতে পছন্দ করেন। তাই রাজি হয়ে গেলেন।
শাহেদ আলী ছেলেবেলায় এতিম হয়ে মা-বাবার স্নেহ মমতা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ীর স্নেহ মমতা পেয়ে তাদেরকে নিজের মা-বাবার মত মনে করতেন। তারা যখন রূপার বিয়ে দেবার জন্য বললেন, তখন আর না করতে পারলেন না। শেষে তাদের মনে কষ্ট হবে ভেবে বিয়ের পাকা ব্যবস্থা করে কাতার চলে গেলেন। কারণ ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই যাওয়ার সময় সমন্ধি কামালকে বললেন, রূপার বিয়েটা যেন ভালভাবে সম্পন্ন হয়।
শাহেদ আলী বিদেশ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন পাত্রের বাবা এসে জয়নুদ্দিনকে বললেন, আমরা আপনার নাতনিকে বৌ করতে পারব না। এ বিয়ে হবে না।
জয়নুদ্দিন খুব অবাক হয়ে বললেন, কেন?
পাত্রের বাবা বললেন, আপনাদের চেয়ে আরো বড় ঘরের মেয়ে আমরা দেখেছি। সেই মেয়ে আপনার নাতনির থেকে অনেক বেশি সুন্দরী।
জয়নুদ্দিন শুনে খুব রেগে গেলেন। বললেন, এ আপনি কি বলছেন? যেখানে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেছে, সেখানে এমন কথা বলতে পারলেন? আমার জামাই মেয়ে ছোট বলে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। আমি বলে কয়ে রাজি করালাম। আপনারা মেয়ে দেখে পছন্দ করে সব ঠিকঠাক করে গেলেন। এখন আবার একি কথা বলছেন? আপনারা কি মানুষ একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবনে দাগ দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এই মেয়ের বিয়ে কি করে হবে, সে কথা চিন্তা করেছেন?
পাত্রের বাবা বললেন, আপনারা যাই বলুন না কেন, আমরা বিয়ে ভেঙ্গে দিলাম। আমরা বড় ঘরের মেয়ে বৌ করব। তারা আপনাদের থেকে অনেক বেশি বড়লোক। সেখানে পাকা কথাবার্তা হয়ে গেছে।
জয়নুদ্দিন আরো রেগে গিয়ে বললেন, আমাদের অবস্থা জেনে শুনেই তো আপনারা এই বিয়ে ঠিক করেছিলেন। এখন আবার গরিব বড়লোকের কথা বলছেন কেন? আপনাদের গায়ে কি একটুও মানুষের চামড়া নেই?
পাত্রের বাবা বললেন, আপনারা যা খুশি বলতে পারেন, তবু আমরা এই কাজ করব না। এ ব্যাপারে আপনাদের যা খরচপাতি হয়েছে বলুন, দিয়ে দিচ্ছি।
কামাল এতক্ষণ বাড়িতে ছিল না। এসে সবকিছু শুনে পাত্রের বাবার সঙ্গে অনেক কথা কাটাকাটি করল। পাত্রের বাবা তাদের কোনো কথায় কর্ণপাত না করে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলেন।
জয়নুদ্দিন স্ত্রী ও কামালকে নিয়ে বদরপুরে এসে মেয়েকে রূপার বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা বললেন।
মেহেরুন্নেসা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বললেন, এ কথা আমি তোমাদের জামাইকে জানাব কেমন কর? সে এখন রূপার বিয়ে দিতে একদম রাজি ছিল না। শুধু আপনাদের কথায় রাজি হয়েছিল। এখন আবার এই কথা জেনে কি করবেন কি জানি?
কামাল বলল, বুবু তুমি কেঁদ না। সবুর কর। আমি রূপার বাবাকে চিঠি দিয়ে বুঝিয়ে বলব। আর তোমরা দোওয়া কর, ইনশাআল্লাহ আমি যেন রূপার বিয়ে অতি শীঘ্র দিতে পারি।
জয়নুদ্দিনও মেয়েকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, তুই কিছু চিন্তা করিস না। আমি তোর মেয়ের বিয়ে তাড়াতাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে রূপার তরুণী মনে বেশ আঘাত লাগল। এরপর তাকে সবাই অপয়া মেয়ে বলে খোটা দেবে, পরে অন্য কোথাও বিয়ে হলেও তাকে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা অনেক কথা শোনাবে, এইসব ভেবে তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
মেহেরুন্নেসা মেয়ের মন খারাপ দেখে একদিন তাকে বললেন, তুই আবার স্কুলে যা।
বিয়ের কথা পাকা হয়ে যাওয়ার পর রূপা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। মায়ের কথা শুনে বলল, আমার বিয়ের কথা স্কুলের মাস্টাা ও ছাত্রীরা অনেকে জেনে গেছে। তারা যখন কিছু জিজ্ঞেস করবে তখন কি বলব? আমি আর স্কুলে যাব না।
মেহেরুন্নেসা আর কিছু বলতে পারলেন না।
এই ঘটনার চার পাঁচ মাসের মধ্যে কামাল চেষ্টা চরিত্র করে বড় ঘরে ভাগনির বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের কাজটা খুব তড়িঘড়ি করতে হল বলে রূপার বাবাকে জানাতে পারল না। বিয়ের পর চিঠিতে বিস্তারিত জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিল।