ডাক্তার যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ হানুফা বিবি চুপ করেছিলেন। ডাক্তার ও ছেলে বেরিয়ে যেতে আবার গজরাতে লাগলেন, কি পাপ না ঘরে এনেছি। এই মেয়ের দ্বারা আমার সংসারের অনেক ক্ষতি হবে। বেশি কিছু বলাও বিপদ। স্বামী ঘরে এলেই আমার বিরুদ্ধে লাগবে। ডাইনী আমার ছেলেকে যাদু করেছে। যাক হারুন এলে বলব, এই বৌ নিয়ে তুই কোনেদিন সুখী হবি না। একে ছেড়ে দে। আমি ভাল মেয়ে দেখে আবার তোর বিয়ে দেব।
রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে মনে ভীষণ আঘাত পেল। অনেক কিছু বলতে তার ইচ্ছা করল; কিন্তু বলে কোনো লাভ হবে না। বরং উল্টো কিছু হতে পারে ভেবে চুপ করে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজাতে লাগল।
হারুন ওষুধ নিয়ে এসে রোকেয়াকে খাওয়াতে গেলে রোকেয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলল, কি হবে ওষুধ খেয়ে? আমি ভালো হতে চাই না। আমাকে তুমি বিষ এনে দাও। খেয়ে তোমাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যাই। সবাই জানবে অসুখ হয়ে মারা গেছি। আর তা না হলে আমাকে তালাক দিয়ে চির জনমের মত বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। তারপর সে দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হারুন তার কথা শুনে বুঝতে পারল, সে ওষুধ আনতে চলে যাওয়ার পর আম্মা নিশ্চয় যা তা করে অনেক গালাগালি করেছে। বলল, ছিঃ রোকা, এরকম কথা তুমি বলতে পারলে? আম্মা তোমাকে যা কিছু বলুক না কেন, আমি কি তোমাকে কোনোদিন কিছু বলেছি? না আমার কাছ থেকে কোনো রকম অবহেলা পেয়েছ? তোমাকে আমি কত ভালবাসি, তাকি তুমি জান না? তোমার কিছু হলে আমিও বাঁচব না। তারপর কান্নায়। তার গলা বুজে এল।
রোকেয়া স্বামীর কথা শুনে বুঝতে পারল তালাকের কথা বলা তার ঠিক হয়নি। কান্না থামিয়ে বলল, অনেক দুঃখে আমার মুখ থেকে হঠাৎ কথাটা বেরিয়ে গেছে। তবু বলে আমি ভীষণ অন্যায় করেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্রিয়তম। আমারও তো রক্ত মাংসের শরীর। আর কতটুকুই বা আমার জ্ঞান? তারপর হারুন ওষুধ আনতে চলে যাওয়ার পর শাশুড়ীর যেসব কথা বলেছিলেন তা বলে বলল, ওঁর কথা শুনে এই অসুস্থ। শরীরে আমার মাথা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তাই বলে ফেলেছি। কথা শেষ করে আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হারুন তাকে প্রবোধ দিতে দিতে চোখ মুখ মুছিয়ে ওষুধ খাওয়াল। তারপর বলল, তোমার কাছে বলতেও আমার লজ্জা করছে; আম্মা যে তোমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার করবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। বিয়ের সময় যখন আম্মা তোমাকে অপছন্দের কথা বলল, তখন ভেবেছিলাম, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর স্ত্রীর দুগালে কয়েকটা চুমো খেয়ে বলল, ক্ষমা তুমি পেয়েছ। তবে যে কথা বলে ফেলে তুমি ক্ষমা চাইলে সেকথা যদি আবার কোনোদিন বল, তাহলে সেদিন আমার মরা মুখ দেখবে।
রোকেয়া স্বামীর মাথা দুহাত দিয়ে ধরে গালে গাল ঠেকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আমি না হয় রাগের মাথায় ঐ কথা বলে ফেলেছি। তাই বলে তুমিও ঐ রকম কথা বললে কি করে? তুমি কি জান না, তুমি আমার সমস্ত তনুমনে মিশে রয়েছ? তোমার কিছু হলে আমিও মরে যাব বলে রাখলাম।
হারুন বলল, আমিও মানুষ। আমারও ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ওয়াদা করছি আর কখনো ওরকম কথা বলব না। তুমিও ওয়াদা কর বলবে না।
রোকেয়া বলল, বেশ, আমিও ওয়াদা করলাম। আল্লাহপাক যেন আমাদেরকে ওয়াদা পালন করার তওফিক এনায়েৎ করেন।
হারুন আমিন বলে বলল, এবার একটা সুখবর শোনাব, কি খাওয়াবে বল।
ডাক্তার যখন হারুনকে রোকেয়ার সন্তান সম্ভাবনার কথা বলেন তখন রোকেয়া শুনেনি। তাই সুখবরটা কি হতে পারে ভেবে পেল না। বলল, তুমি যা খেতে চাইবে তাই করে খাওয়াব।
হারুন বলল, আমি কিন্তু খাবার খাওয়াবার কথা বলিনি।
ওমা, খাবারই তো তোক খেতে চায়। অন্য কিছু আবার খাওয়ার জিনিস আছে নাকি?
আছে আছে, তুমি না জানলে কি হবে।
তা হলে কি খাবে তুমিই বল।
হারুন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল।
রোকেয়া লজ্জায় লাল হয়ে স্বামীর পিঠে কয়েকটা কিল দিয়ে বলল, দুষ্ট। যাও তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এই কথা বলে তাকে হাত দিয়ে ঠেলে দিল।
হারুন হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে, সুখবরটা আমিও শোনাব না। এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভান করল।
রোকেয়া খপ করে তার একটা হাত ধরে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, দুষ্টু লোকের সাথে দুষ্টুমী করলে দোষ হয় না। ঠিক আছে, তাই খাওয়াব। তারপর লজ্জায় স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলল, এবার সুখবরটা শোনাও।
হারুন বলল, তুমি মা হতে চলেছ। এই, তুমি মা হলে আমিও বাবা হব তাই না?
রোকেয়া আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, জানি না যাও। তুমি জানলে কি করে?
হারুন বলল, ডাক্তার বলেছেন। দেখো রোকা, আমাদের ছেলে হবে।
না, মেয়ে হবে।
আচ্ছা দেখা যাবে কার কথা ঠিক।
শুনেছি যাদের নাকি প্রথমে মেয়ে হয়। তাদের জন্য বেহেস্তের দরজা খোলা থাকে।
কথাটা আমিও শুনেছি। তবে হাদিস কালামে আছে কিনা জানি না। যাক, এবার আর একটা সুখবর শুন, আমার যাওয়ার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। তাই আগামীকাল তোমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসব।
রোকেয়া খুশি হয়ে বলল, তাই হবে।
পরের দিন সকালে হারুন মাকে বলল, আজ তোমার বৌকে নিয়ে বদরপুর যাব। কয়েকদিন পরে তো আমার ফ্লাইট। তাই সকলের সঙ্গে দেখা করে আসব।