হানুফা বিবি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোরা যা আমি আসছি।
ঐদিন রাতে ঘুমোবার আগে হারুন রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের কবে বিয়ে হয়েছিল তোমার মনে আছে?
রোকেয়া বলল, ঐ দিনটার কথা কি কেউ ভুলে? ঐ দিনটা চিরকাল আমার অন্তরে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। হঠাৎ ঐ দিনের কথা জিজ্ঞেস করলে কেন?
হারুন বলল, না এমনি জিজ্ঞেস করে দেখলাম, তোমার মনে আছে কিনা। আমিও। ঐ দিনের কথা জীবনে ভুলতে পারব না। তারিখটা তোমার মনে আছে?
রোকেয়া বলল, ১০-৪-৮৩ইং তারিখ।
হারুন তাকে আদর করতে করতে বলল, আজ ১০-৭-৮৩ তারিখ। আমি এই মাসের ২৩ তারিখে বিদেশ চলে যাব। তোমাকে ছেড়ে যেতে মোটেই ইচ্ছা করছে না। সত্যি রোকা, তোমার জন্য আমার খুব দুঃখ হয়, কেন যে তোমাকে বিয়ে করে এত কষ্ট দিচ্ছি? যদি জানতাম, বিয়ের পর এত দুঃখ কষ্ট পেতে হয়, তাহলে বিয়েই করতাম না। তার উপর তোমাকে রেখে চলে যাব, আবার কবে তোমাকে পাব, সে কথা মনে করে ভীষণ খারাপ লাগছে। তারপর কান্নায় তার গলা বুঝে এল।
রোকেয়া আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, তুমি আমাকে ধৈৰ্য্য ধরার কথা বলে নিজেই ধৈৰ্য্যহারা হচ্ছ কেন? বরং তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে অতদিন থাকব, সে কথা তোমার ভাবা উচিত। আম্মার এতকিছু অত্যাচার তোমাকে দেখলেই ভুলে যাই। তুমি চলে গেলে কাকে দেখে ভুলব বলতে পার? বিরহ জ্বালা কি তুমি একাই পাবে, আমি পাব না?
হারুন ভিজে গলায় বলল, রোকা, তুমি এমন করে বলো না। সেই কথা ভেবেই তো আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কি করি বল, আমাদের বিষয় সম্পত্তি তেমন নেই যে, ঘরে থাকলে সংসার চলবে। তাই তো মন না চাইলেও আপনজনদের ফেলে সুদূর বিদেশে যেতে হচ্ছে। যদি সংসার চলার মত কিছু সংস্থান থাকত, তাহলে কি কেউ সখ করে আপনজনদের ফেলে বিদেশে যেতে চায়? আমার ইচ্ছা হয়, সব সময় তোমার পাশে থাকি। তারপর চোখ মুছে বলল, আল্লাহ আবার কবে তোমার কাছে নিয়ে আসবেন, তা তিনিই জানেন।
স্বামীর কথা শুনতে শুনতে রোকেয়ার চোখ থেকেও পানি পড়ছিল। সেই অবস্থাতে তার বুকে মাথা রেখে বলল, তুমি চলে যাবে শুনে আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে আমিই বা কি করে থাকব, সে কথা ভেবে পাচ্ছি না। সংসারে যত অশান্ত পাই না কেন, তোমার চাঁদ মুখ দেখলেই সে সব কর্পূরের মত উড়ে যায়। মন শান্তিতে ভরে যায়। তুমি চলে গেলে আমি কি করে এখানে দিন গুজরান করব, তুমি বলে দাও প্রিয়তম।
হারুন তাকে আদর দিতে দিতে বলল, ধৈৰ্য্য ধর রোকা ধৈর্য্য ধর। তোমাকে রেখে যেতে আমারও যে খুব কষ্ট হবে তা তুমিও জান। তুমি এত ভেঙ্গে পড়লে আমি যাব কি করে? রোকেয়ার মালিকের ডেটমত মাসিক না হয়ে বেশ কয়েকদিন আগে পার হয়ে গেছে, সে কথা হারুন জানে। তাই অনুমান করে তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল, এই রোকা, আল্লাহ চাহে যদি সত্যি সত্যি তোমার পেটে বাচ্চা এসে থাকে। তাহলে আমি বলছি, আমাদের ছেলে হবে। এই কথা শুনে রোকেয়া ভীষণ লজ্জা পেয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে চুপ করে রইল।
কি হল কিছু বলছ না যে?
এসব কথা বললে আমার লজ্জা পায় না বুঝি?
লজ্জা আছে বলে পাচ্ছে। তাই বলে যা সত্য তা বলব না? বল না, ছেলে হবে, না মেয়ে হবে?
সে কথা আল্লাহপাক জানেন, আমি বলব কি করে? তবে আমার ইচ্ছা প্রথমে মেয়ে হোক। এখন ও কথা থাক, সত্যি কি আর পেটে বাচ্চা এসেছে? মাঝে মাঝে আমার মাসিকের ডিস্টার্ব হয়।
তিন চার দিন পরের ঘটনা। সেদিন রোকেয়ার শরীর বেশ খারাপ লাগছিল বলে সংসারের কাজকর্ম না করে শুয়েছিল।
তাই দেখে হানুফা বিবি তার রুমের দরজার কাছে এসে বড় গলায় বললেন, নবাবজাদীর মতো শুয়ে আছিস যে? বাপের বাড়ি থেকে পাঁচ দশটা বাদী এনেছিস বুঝি? তারা সংসারের কাজ করবে? ভালো চাসতো উঠে কাজকর্ম কর নচেৎ কি করি বুঝবি।
রোকেয়া শাশুড়ীর কথা শুনে উঠে বসতে গেল; কিন্তু মাথা ঘুরে যেতে আবার শুয়ে পড়ল।
হানুফা বিবি তা লক্ষ্য করে বললেন, একটা ব্যামো মেয়ে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছে। বাপ-মাকে খবর দে, তারা এসে নিয়ে যাক। চিকিৎসা করাক। আমার অত টাকা পয়সা নেই যে, তোর চিকিৎসা করাব।
এমন সময় হারুন ঘরে এসে মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারল, রোকেয়ার কিছু অসুখ বিসুখ হয়েছে। মাকে বলল, আম্মা তুমি এসব কি বলছ? মানুষের কি অসুখ বিসুখ করে না? এর আগে তো তোমার বৌয়ের কোনোদিন কিছু হয়নি। তারপর মা কিছু বলার আগে আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেল।
হানুফা বিবি আরো রেগে গিয়ে বৌয়ের গুষ্ঠি তুলে গাল দিতে দিতে সংসারের কাজ করতে লাগলেন।
রোকেয়া সেসব সহ্য করতে না পেরে কাজ করার জন্য আরো দুতিন বার বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রতিবারেই মাথা ঘুরে চোখতলা ধুয়া হয়ে গেল। শেষে বিফল হয়ে শুয়ে শাশুড়ীর গালাগালি শুনতে শুনতে চোখের পানি ফেলতে লাগল।
ঘন্টাখানেক পরে হারুন ডাক্তার নিয়ে ফিরে এল।
ডাক্তার রোকেয়াকে পরীক্ষা করে প্রেসক্রিপসান করার সময় হারুনকে বললেন, খুব সম্ভব আপনার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। ওঁকে এখন থেকে একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলবেন। তারপর তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর হারুন লজ্জায় মাকে ডাক্তারের কথা বলতে পারল না। টাকা নিয়ে ওষুধ কিনতে চলে গেল।