হারুন বলল, আমরা কি তোমাকে সেধে পাঠিয়েছিলাম, না তুমি নিজে যাবে বলে তোমার বৌকে সবকিছু সামলাতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলে? যদি সে বলত পারব না, তখন তো তার দোষ দিতে। আর পারবে বলতে তার দোষ হয়ে গেল? তুমি যে কেন এমন কাণ্ড শুরু করেছ, তা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ছেলের কথা শুনে হানুফা বিবি বললেন, বিয়ে করেছিস তো, এখন বৌয়ের হয়ে কথা না বললে তার মন পাবি কেন? তারপর গজর গজর করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
হারুনের বাবা বদরুদ্দিন খুব ভাল লোক ছিলেন। তিনি স্ত্রীর স্বভাব চরিত্র জানতে পেরে তাকে খুব কড়া শাসনে রাখতেন। এ্যাকসিডেন্টের পর যখন উনি প্রায় দুবছর প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন এবং ব্রেনের ডিফেক্ট হয়ে গেল তখন থেকে হানুফা বিবি বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
বদরুদ্দিন রোকেয়াকে খুব ভালবাসেন। সারাদিন রোকেয়াকে বৌমা বৌমা করে ডাকেন। রোকেয়া এসে যদি জিজ্ঞেস করে, কেন ডেকেছেন আব্বা? তখন বলেন, এমনি ডেকেছি। আসলে এ্যাকসিডেন্টের পর থেকে শারীরিক কিছু সুস্থ হলেও মাথার গোলমাল রয়ে গেছে। কখন কাকে কি বলেন কিছুই মনে রাখতে পারেন না।
রোকেয়া বৌ হয়ে আসার পর একদিন হনুফা বিবিই তাকে স্বামীর এই অবস্থার কথা বলে বলেছিলেন, তোর শ্বশুরের কথায় তুই কিছু মনে করিস না। সেই জন্যে বদরুদ্দিন বৌকে ভালবাসলেও যখন মাঝে মাঝে গালাগালি করেন তখন রোকেয়া কিছুমনে করে না। উনি রেগে গেলে শুধু রোকেয়াকে নয়, বাড়ির সবাইকে গালাগালি করেন।
একদিন রান্নার ব্যাপার নিয়ে হানুফা বিবি রোকেয়ার বাপ মা তুলে যাচ্ছে তাই করে গালাগালি করলেন।
এর আগেও রোকেয়া শাশুড়ীর অনেক গালাগালি সহ্য করেছে। কিন্তু আজ তার মা-বাপ তুলে গালাগালি করাতে তার মনে খুব কষ্ট হল। সহ্য করতে না পেরে বলল, আপনি যখন তখন শুধু শুধু আমাকে গালাগালি করেন; তবু আমি কিছু বলি না! কিন্তু • আমার মা-বাপকে গালাগালি করছেন কেন? এখানে তারা কি দোষ করল?
হানুফা বিবি রেগে আগুন হয়ে বললেন, কি বললি তুই! এত দেমাগ তোর? আমার মুখের উপর আবার কথা বলা? তোকে আমি পছন্দ করে আনি নাই যে, আদর সোহাগ করব। আর তোর মা-বাপ কোন দেশের নবাব-বেগম যে, কিছু বললে, তাদের অপমান হবে? আমার যা ইচ্ছা তাই বলব, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আজ হারুন ঘরে আসুক জিজ্ঞেস করব, সে তোকে আমার সাথে ঝগড়া করতে শিখিয়ে দিয়েছে কিনা?
শাশুড়ীর কথা শুনে রোকেয়া আকাশ থেকে পড়ল। ভাবল, আমি আবার ঝগড়া করলাম কখন? যদি বলি আম্মা, আপনি এ আবার কি কথা বলছেন, তাহলে হয়তো আরো যা তা বলে গালাগালি করবেন? তাই আর কথা না বাড়িয়ে রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এলাম তখন কত আশা, কত আনন্দ ছিল। মনে করেছিলাম, শ্বশুর বাড়ি খুব সুখের হয়। কত স্বপ্ন, কত কল্পনার জাল বুনেছিলাম। কিন্তু তখন জানতাম না যে, সাংসারিক জীবনে কত দুঃখকষ্ট আছে। হায়রে ভাগ্যের পরিহাস, সারাজীবন এখানে কাটাব কি করে? এই সব চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
হারুন ঘরে এলে হনুফা বিবি ছেলেকে অনেক কিছু মিথ্যে বানিয়ে বৌয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করে বললেন, তুই কি বৌ করে এনেছিস আমার সঙ্গে ঝগড়া করাবার জন্য? তুই যদি এর বিহিত না করিস, তাহলে এখানে এক ঘোঁট পানিও খাব না।
হারুন মায়ের স্বভাব জানলেও তার শেষের কথা শুনে রোকেয়ার উপর খুব রেগে গেল। রুমে এসে তাকে কিছু বলতে গিয়ে তার বিমর্ষ মুখ দেখে থেমে গেল। বুঝতে পারল মা এমন কিছু আজ বলেছে, যে জন্যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাটের কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বলল, রোকা উঠ।
রোকেয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বলল, কখন এলে?
হারুন বলল, এই তো এলাম। তারপর আবার বলল, আজ আম্মার সঙ্গে আবার কি হল, যে জন্য সে এখানে কিছু খাবে না বলেছে?
রোকেয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যা কিছু হয়েছিল বলল।
হারুন জানে রোকেয়া কোনোদিন অন্যায়ভাবে আম্মার সাথে কথা বলবে না। তবু মায়ের কথা শুনে আজ রোকেয়ার উপর খুব রেগে গিয়েছিল। কিন্তু রুমে এসে তার। অবস্থা দেখে ও তার কথা শুনে সেই রাগ আর রইল না। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর দিতে। দিতে বলল, চল আমার সঙ্গে আম্মার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নেবে। তা না হলে আম্মা যখন একবার বলেছে এখানে কিছু খাবে না তখন সত্যিই না খেয়ে থাকবে। নচেৎ। বাপের বাড়ি চলে যাবে। সেখানে আবার তোমার ও আমার নামে দুর্নাম রটাবে। তখন কেলেংকারীর শেষ থাকবে না।
রোকেয়া স্বামীর আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, তুমি খুব খাঁটি কথা বলেছ। চল যাই।
হারুন রুম থেকে বেরোবার আগে রোকেয়া শাশুড়ীর কাছে এসে তার দুপা জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা আমার অন্যায় হয়ে গেছে; আমাকে মাফ করে দিন। তারপর সে নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
হনুফা বিবি বৌকে কাঁদতে দেখে মনে করলেন, হারুন নিশ্চয়ই তাকে মারধর করেছে। তাই মনে মনে খুশী হয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করে চুপ করে রইলেন।
একটু পরে হারুন সেখানে এসে মায়ের একটা হাত ধরে বলল, তোমার বৌকে যা করার করেছি। এবার চল ভাত খেতে দেবে, বড় ক্ষিধে পেয়েছে।