আমার ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দাও। আর কখনো এ রকম হবে না। হারুন তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, মাফ চাইলে কেন? আমার কথায় রাগ করেছ নিশ্চয়?
রোকেয়া আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, রাগ করব কেন? ভুল করেছি, সে জন্য মাফ চাইলাম।
কয়েক দিন পর হনুফা বিবি রোকেয়াকে বললেন, আমি বাপের বাড়ি যাব, তুই সংসারের সব কাজ সামলাতে পারবি তো?
রোকেয়া শ্বশুর বাড়ি আসার পর থেকে শাশুড়ীকে তার সঙ্গে তুই সম্বোধন করে কথা বলেন বলে এবং গালাগালি করেন বলে তার মনে খুব ব্যথা লাগে। তারপর নিজের মনকে বুঝিয়েছে, তার আম্মাও তো তাকে তুই করে বলে। এই কথা ভেবে মনকে বোধ দিয়েছে। আজ শাশুড়ীর কথা বলার ধরন দেখে ব্যথাটা আবার টনটন করে উঠল। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, হ্যাঁ আম্মা, আমি সবকিছু সামলাতে পারব। সেদিন বিকেলে হানুফা বিবি বাপের বাড়ি চলে গেলেন।
রোকেয়ার মেজ ভাই বখতিয়ার একদিন সকালের দিকে রোকেয়াদের বাড়িতে এসে তাকে বলল, নানির খুব অসুখ। তুই দেখতে যাবি না?
রোকেয়া বলল, ওতো ঘরে নেই। তুমি এবেলা থাক। সে ঘরে এলে বিকেলে তিনজনে এক সঙ্গে যাব।
বখতিয়ার বলল, ঠিক আছে তাই হবে।
হারুন দুপুরে ফিরে বখতিয়ারকে দেখে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করল।
বখতিয়ার বলল, আমরা সবাই আল্লাহ পাকের রহমতে ভালো আছি। তবে নানির খুব অসুখ। তাই তোমাদেরকে খবরটা দিতে এলাম।
হারুন বলল, তাই নাকি? তাহলে তো নানিকে দেখতে যাওয়া আমাদের উচিত।
তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কর। তোমাকে নিয়ে নানিকে দেখতে যাব।
রোকেয়া বলল, আম্মা বাড়িতে নেই। আমি যাব কি করে? তার চেয়ে খেয়ে দেয়ে তুমি মেজ ভাইয়ার সঙ্গে গিয়ে দেখে এস।
হারুন বলল, আম্মা নেই বলে তুমি নানির কঠিন অসুখের কথা শুনেও দেখতে যাবে না, এ কেমন কথা? আমরা তো আর সেখানে থাকতে যাচ্ছি না? নানিকে দেখে চলে আসব। খেয়ে দেয়ে তুমিও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
বিকেল চারটের সময় হারুন, বখতিয়ার ও রোকেয়া নানির বাড়ি এসে পৌঁছাল। নানিকে দেখে নাস্তা খেয়ে হারুন রোকেয়াকে নিয়ে ফিরে এল।
পরের দিন রোকেয়া হারুনকে বলল, কতদিন হয়ে গেল আম্মা গেছেন। তুমি গিয়ে নিয়ে এস।
হারুন সেইদিন বিকেলে গিয়ে আম্মাকে নিয়ে এল।
হানুফা বিবি আসার পর রোকেয়ার ছোট দেবর মজিদ মাকে বলল, ভাবি ভাইয়াকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল।
এই কথা শুনে হানুফা বিবির মুখে থেকে তুফান শুরু হল। সাগরের গর্জনের মতো গলার আওয়াজ করে বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি বাড়িতে না থাকলে তোর খুব সুবিধে হয়। স্বামীকে নিয়ে হেথা সেথা বেড়াবার সুযোগ পাস। এটা সেটা বাপের বাড়ি চালান করতে পারিস। তাই তো বলি, দশ বার দিন হয়ে গেল হারুন আমাকে নিয়ে আসেনি কেন? কেমন আছি একবার দেখতেও আসল না?
শাশুড়ীর কথায় রোকেয়ার চোখে পানি এসে গেল। কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে গেল। হারুন তখন ঘরে ছিল না। ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে সবকিছু শুনে মায়ের কাছে এসে বলল, আম্মা, তুমি তোমাদের বৌকে কি বলেছ। আমার নানি শাশুড়ীর কঠিন অসুখের খবর পেয়ে আমিই তোমার বৌকে নিয়ে গতকাল দেখতে গিয়েছিলাম। তার বাপের বাড়ি যাইনি।
হানুফা বিবি আরো রেগে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সব বুঝি। তোকে আর বৌয়ের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। তুই তোর কাজে যা।
হারুন আর কিছু না বলে রুমে এসে রোকেয়াকে কাঁদতে দেখে বলল, আম্মার কথায় কেঁদো না। জান তো আম্মা ঐ রকম। আমি তুমি ঠিক থাকলে কেউ কিছু বললেও আমাদের কিছু যায় আসে না।
এর তিন চারদিন আগে থেকে হারুনের বাবা বদরুদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাঁটতে পারেন না। কথাও ঠিকমতো বলতে পারেন না। উল্টো পাল্টা বলেন। হারুন ডাক্তার নিয়ে এসে দেখিয়েছে। এই ডাক্তার তার এ্যাকসিডেন্টের পর থেকে দেখছেন।
ডাক্তার দেখে বলেছেন, এরকম তো প্রায়ই হয়। কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।
হারুন ঘরে চলে যাওয়ার পর হানুফা বিবি স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে ভাত খেয়েছ?
বদরুদ্দিন বললেন, না বৌমা আমাকে খেতে দেয়নি।
হানুফা বিবি আর যান কোথায়? স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বাড়ির লোকজনদের ডেকে বললেন, এত লোক থাকতে হারুনের বাপকে কেউ এক মুঠো ভাত দিতে পারল না। আজ কদিন ধরে সে উপোস রয়েছে। আমি বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। তাই তোমরা এই অসুস্থ লোকটাকে না খাইয়ে রেখেছ?
রোকেয়ার দুজন দেবর শামসু ও হোসেন সেখানে ছিল। তারা বলল, আম্মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? আব্বা যে উল্টো পাল্টা কথা বলে সেটাতো আজ নূতন নয়। পাঁচ ছ বছর ধরে এ রকম করছে। জেনেশুনে কেন তুমি এরকম বলছ?
হারুনও বাইরে এসে বলল, আমাদের সকলের সাথে তোমাদের বৌ যদি আব্বাকে না খাওয়াত, তাহলে না হয় আব্বার কথা বিশ্বাস করা যেত। আম্মা, তুমি যা আরম্ভ করেছ, তা লোকে শুনলে কি বলবে?
হানুফা বিবির তবু রাগ পড়ল না। বললেন, লোকে যাই বলুক না কেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কি কাউকে ভয় করি নাকি? সেদিন তোর বৌ বলল, সে সবদিক সামলাতে পারবে। তাই বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, কেন বলেছিল। আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে তোরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়ে ফুর্তি করে কাটিয়েছিস। কে খেল না খেল সেদিকে খেয়াল করবি কেন?