মা ফাতেমা প্রতিদিন ফিরে যাওয়ার সময় কাঠুরিয়ার স্ত্রীর কথা এবং নবী করিম (সঃ) কেন তাকে এনার কাছে দেখা করতে বললেন, এর ভেদ কি, চিন্তা করে কিছু সমাধান করতে পারেন নাই। এখন কাঠুরিয়ার স্ত্রীর কথা শুনে কিছু না বলে সেই কথা আবার চিন্তা করতে লাগলেন। কাঠুরিয়ার স্ত্রী সাধ্যমত খাতির যত্ন করে নাস্তা পানি করালেন। নাস্তা পানির পর মা ফাতেমা (রাঃ) ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, রশি, ছেঁড়া জুতো, ছোট বড় পাথর এবং কয়েক পদের চাবুক বেশ সুন্দর করে একপাশে। গোছান রয়েছে। এইসব দেখে তার বেশ কৌতূহল জন্মাল। কথা বলতে বলতে এক সময় কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ঐগুলোর দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ জিনিসগুলো অত সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখেছেন কেন?
কাঠুরিয়ার স্ত্রী বললেন, আমার স্বামী সারাদিন কাঠ কেটে বাজারে বক্রি করে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরেন। সারাদিন পরিশ্রম করার ফলে কোনো কোনোদিন তার মেজাজ গরম থাকে। সেদিন বাড়িতে এসে সামান্য কোনো কারণে রেগে গিয়ে আমাকে মারধর করেন। আমাকে মারার জন্য যাতে কোনো কিছু খোঁজা-খুঁজি করতে না হয় সেজন্যে আমি ঐগুলো রেখেছি। যেটা দিয়ে ওর আমাকে মারার ইচ্ছা হবে, সেটা সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যাবেন।
কাঠুরিয়ার স্ত্রীর কথা শুনে মা ফাতেমা (রাঃ) যেমন খুব অবাক হলেন তেমনি তার স্বামী ভক্তির কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। সেই সঙ্গে এ কথাও বুঝতে পারলেন, তার কথাগুলো শুনে নবী করিম (সঃ) কেন তাকে আগে কাঠুরিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন। কাঠুরিয়ার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে মা ফাতেমা (রাঃ) স্বামী হযরত আলী (কঃ) র পায়ে ধার ক্ষমা চেয়ে নেন।
ঘটনাটা বলে রহিমন বিবি রোকেয়ার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, শুনলি তো কাঠুরিয়ার স্ত্রীর স্বামীভক্তির কথা? আজকালের মেয়েরা স্কুল কলেজে পড়ে স্বামীকে গ্রাহ্য করে না, এটা যে কতবড় গোনাহর কাজ তা যদি জানত, তাহলে করতে পারত না। দোয়া করি, আল্লাহপাক যেন তোকে মা ফাতেমা (রাঃ) এর মত স্বামীভক্ত স্ত্রী করেন।
রোকেয়া নানির পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আপনি দোয়া করুন নানি, আমি যেন আপনার সব কথা মেনে চলতে পারি।
রহিমন বিবি নাতনির মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ তোকে সব কিছু সহ্য করার ও সব কিছু মেনে চলার তওফিক দান করুক।
পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে তিনি চলে গেলেন।
.
০৪.
রহিমন বিবি চলে যাওয়ার পর ঐ দিনই হনুফা বিবি রোকেয়াকে সংসারের কাজে লাগিয়ে দিলেন।
রোকেয়া বাপের বাড়িতে সংসারের কাজ করে বড় হয়নি। তার মা মেহেরুন্নেসা মাঝে মাঝে বকাঝকা করে শুধা রান্না করা শিখিয়েছেন। রোকেয়া শ্বশুর বাড়ি এসেই। শাশুড়ীর যা পরিচয় পেয়েছে তাতে ভয়ে তার বুক কাঁপে। তার উপর নূতন বৌ। কোনো কাজ করতে গেলে ভুল না হলেও ভুল হয়ে যায়।
তাই দেখে হানুফা বিবি প্রথম দিন থেকেই রোকেয়ার উপর রাগারাগি শুরু করলেন। যা তা বলে গালাগালি দিতে লাগলেন।
শাশুড়ীর ব্যবহারে রোকেয়া মনে ভীষণ আঘাত পেল। তবু কিছু না বলে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে ভাসাতে সংসারের কাজকর্ম করতে লাগল। আর মনে মনে আল্লাহ পাকের কাছে জানাল, আল্লাহ পাক, তুমি যখন আমার তকদিরে এইসব রেখেছ তখন আমাকে সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা দাও।
একদিন রোকেয়া ঘরদোর পরিষ্কার করে আবর্জনাগুলো ঘরের পিছনে ফেলে দিয়ে এলে হানুফা বিবি ঝংকার দিয়ে বললেন, তোর মা কাজ না শিখিয়ে বিদেশী জামাই পেয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। জেনে রাখ, সংসারের কাজকর্ম যেমন তেমন করে করা চলবে না। তারপর উঠোনের কয়েক দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বললেন, ঐ সব জায়গায় আবর্জনা রয়েছে চোখে দেখিস না? এতবড় ধিঙ্গী মেয়ে ঝাড় দিতেও জানিস না, না এখন থেকেই কাজে ফাঁকি দিতে আরম্ভ করছিস?
রোকেয়া উঠোনের চারপাশে তাকিয়ে কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে বলল, কই আম্মা, আমি তো কোনো আবর্জনা দেখছি না।
হানুফা বিবি গর্জন করে উঠলেন, কি তোর এতবড় স্পর্ধা? কাল বৌ হয়ে এসে আমার মুখে মুখে তর্ক? হারুন ঘরে আসুক, এর বিহিত করে ছাড়ব।
রোকেয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে পরিষ্কার উঠোন আবার ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করল।
সেদিন রাতে হারুন ঘরে এলে হনুফা বিবি ছেলেকে খুব রাগের সাথে বললেন, তোর বৌ উঠোন ঝাট দিতে জানে না। তাই আমি তাকে বুঝিয়ে বলতে গেলে আমার মুখে মুখে তর্ক করেছে। তুই এর বিহিত কর। মেয়ে দেখতে গিয়ে ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়ে ভালো হবে না।
রোকেয়া তখন নিজের ঘরে ছিল। হারুন তার কাছে গিয়ে বলল, রোকা, আম্মা কি বলল শুনেছ?
রোকেয়া আর কি বলবে, শাশুড়ীর মিথ্যে অভিযোগ শুনে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। ভাবল, সত্য কথা বললে, ও ছেলের মধ্যে ঝগড়া হবে। তাই সে চুপ করে রইল।
হারুন বলল, আমার কথার উত্তর দেবে না?
রোকেয়া চোখ মুছে বলল, আমি কোন দিকে যাব? কাজ করলেও দোষ আর না করলেও দোষ।
হারুন বলল, সে কথা আমি জানি। আম্মার মুখে মুখে তর্ক করেছ নাকি?
রোকেয়া উঠোন ঝাঁট দেওয়ার সময় যা বলেছিল তা বলল।
তুমি তো জান রোকা, আম্মা ঐ রকম। তবু কেন কথা বলতে গেলে? তোমাকে বলেছি না, আম্মা সত্য মিথ্যা যাই বলুক না কেন, তুমি কোনো উত্তর করবে না?