রোকেয়াও এতক্ষণ স্বামীর সঙ্গে দুহাত তুলে আমিন আমিন করছিল। মোনাজাত শেষ হতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা আমাকে পছন্দ করেন না, এই কথা মনে হলে আমার ভয় করে।
হারুন তাকে আদর করতে করতে বলল, ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি তো আছি। আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে আম্মার মন জয় করার চেষ্টা করবে। আব্বার দিকেও সব সময় লক্ষ্য রাখবে। জানতো পিতামাতার পদতলে সন্তানের বেহেস্ত? তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখলে যেমন ইহকালে ও পরকালে সুখ-শান্তি পাওয়া যায়, তেমনি অসন্তুষ্ট রাখলে ইহকালে দুঃখ ও অশান্তিতে ভুগতে হয় এবং পরকালে ও অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হয়। এবার অন্য কথায় আসি। দেখ রোকা, তুমি আর আমি কত কাছে, কিন্তু তবু মনে হচ্ছে কত দূরে।
রোকেয়া কথাটা বুঝতে না পেরে বলল, কেন প্রিয় এমন কথা বলছেন? আমি তো আপনার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছি।
হারুন হেসে উঠে বলল, তাই যদি হয়, তাহলে আমাকে এতক্ষণ আপনি করে বলে দূরে সরিয়ে রেখেছ কেন?
রোকেয়া ও হেসে উঠে বলল, তাই বল; আমি তো তোমার কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
হারুন বলল, এই তো আমর প্রাণের রোকা আমাকে এবার কাছে টেনে নিল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে অস্থির করে তুলল।
রোকেয়া প্রথম দিকে লজ্জায় চুপ করে থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিদানে মেতে উঠল।
এভাবে তারা সারারাত আনন্দ ফুর্তি করে কাটাল।
.
হানুফা বিবির আব্বা আনসার উদ্দিন খুব অমায়িক লোক। বয়স ষাটের উপর। খুব রসিক লোক। বিয়ের পরের দিন তিনি রোকেয়ার চুল ও চোখের গোড়ার তিল দেখে হাসতে হাসতে বললেন, এই যে নাতবৌ, এইসব দেখলাম বলে রাগ করলে নাকি? আমরা যাকে পছন্দ করেছিলাম, তাকে পেলাম কি না টেস্ট করলাম। তারপর তিনি নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে লাগলেন। সেখানে হারুনসহ অন্যান্যরা যারা ছিল, তারাও হাসিতে যোগ দিল।
রোকেয়ার নানি রহিমন বিবি দুদিন থেকে কাল সকালে চলে যাবেন। রাতে সে কথা জানাতে রোকেয়া নানিকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে লাগল।
রহিমন বিবি নাতনিকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বললেন, কাদিস না বোন কাদিস না। কেঁদে আর কি করবি। মেয়েদের আসল বাড়ি হল স্বামীর বাড়ি। সংসারের সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করবি। শ্বশুর শাশুড়ীকে নিজের মা-বাবার মত মনে করবি। ওঁরা কিছু বললে, প্রতি উত্তর করবি না। তোর মা-বাবাও তো অনেক সময় তোকে বকাবকি করেছে। ওঁরা যদি তাই করেন, তাহলে মনে করবি নিজের মা বাবা করছেন। আর শোন, ঠিকমত নামায রোযা করবি। স্বামীর মনে কোনোদিন কষ্ট দিবি না। যা বলবে তৎক্ষণাৎ তা শুনবি। মনে রাখিস, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত। আমাদের নবী (সঃ) এর মেয়ে মা ফাতেমা (রাঃ)-র একটা ঘটনা বলছি শোন, একদিন মা ফাতেমা (রাঃ) নিজেকে ফুলের রাণী গোলাপ ফুলের সঙ্গে তুলনা করলেন। তখন হযরত আলী (কঃ) বললেন, গোলাপ ফুল কিন্তু তাড়াতাড়ি মলিন হয়ে যায় এবং ঝরেও যায়। এই কথায় মা ফাতেমা (রাঃ)র মনে একটু অভিমান হল। তিনি নবী করিম (সঃ) এর কাছে এসে স্বামীর কথা বলে নালিশ করলেন। নবী করিম (দঃ) বললেন, তোমার নালিশের ফায়সালা পরে করব। তার আগে অমুক মহল্লায় যে কাঠুরিয়া বাস করে,তার স্ত্রীর সঙ্গে তুমি দেখা করে এস।
মা ফাতেমা (রাঃ) সেই কাঠুরিয়ার বাড়ির দরজায় এসে সালাম জানালেন।
কাঠুরিয়ার স্ত্রী দরজা না খুলে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কে আপনি?
মা ফাতেমা (রাঃ) নিজের পরিচয় দিলেন। কাঠুরিয়ার স্ত্রী বললেন, বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনি আগামীকাল আসুন। আমি আপনার আগমনের কথা বলে আমার স্বামীর হুকুম নিয়ে রাখব।
মা ফাতেমা (রাঃ) ফিরে এলেন। পরেরদিন কাঠুরিয়ার বাড়িতে যখন রওয়ানা হবেন তখন ছোট ছেলে হযরত হোসায়েন (রাঃ) বললেন, আম্মা, আমি আপনার সঙ্গে যাব। উনি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাঠুরিয়ার বাড়ির দরজায় এসে সালাম জানালেন।
কাঠুরিয়ার স্ত্রী সালামের উত্তর দিয়ে দরজা খুলে সঙ্গে একটা ছেলে দেখে বললেন, মাফ করবেন, আমি আমার স্বামীর কাছে শুধু আপনার আসার হুকুম নিয়েছিলাম। তাই এই ছেলেসহ বাড়িতে ঢুকতে দিতে পারব না। আগামীকাল আসুন, আমার স্বামীর হুকুম। নিয়ে রাখব।
মা ফাতেমা (রাঃ) ফিরে এলেন। পরের দিন যাওয়ার সময় হযরত হাসান ও হোসায়েন (রাঃ) দুজনেই মায়ের সঙ্গে যাওয়ার জন্যে জীদ ধরলেন। ছোট ছোট ছেলেদের আবদার তিনি না রেখে পারলেন না। দুভাইকে সঙ্গে নিয়ে কাঠুরিয়ার দরজায় এসে সালাম দিলেন।
কাঠুরিয়ার স্ত্রী সালামের উত্তর দিয়ে দরজা খুলে আজ দুটো ছেলেকে দেখে বললেন, মাফ করবেন, আজও আপনাকে ভিতরে আসতে দিতে পারছি না। কারণ আমি স্বামীর কাছ থেকে একটা ছেলের কথা বলে হুকুম নিয়েছিলাম। আপনি দয়া করে আগামীকাল আসুন।
অগত্যা বাধ্য হয়ে মা ফাতেমা (রাঃ) সেদিনও ফিরে এলেন।
ঐ রাতে কাঠুরিয়া বাড়িতে ফিরে আসার পর যখন তার স্ত্রী ঘটনাটা বললেন তখন খুব রেগে গিয়ে বললেন, তুমি এই কদিন খুব অন্যায় করেছ। মা ফাতেমা (রাঃ) যদি দুনিয়াশুদ্ধ লোক নিয়ে আসেন, তবুও তাকে আর ফেরাবে না।
চতুর্থ দিন মা ফাতেমা (রাঃ) দুছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাঠুরিয়ার বাড়িতে এসে সালাম দিলেন।
কাঠুরিয়ার স্ত্রী সালামের উত্তর দিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে অতি ভক্তি ও সম্মানের সাথে ঘরে নিয়ে এসে বসিয়ে বললেন, এই কদিন আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি খুব অন্যায় করেছি। আমাকে মাফ করে দিন।