রোকেয়ার সঙ্গে তার নানি রহিমন বিবি এসেছেণ। তিনি এদের কাণ্ডকারখানা দেখেশুনে চিন্তা করতে লাগলেন, এ কেমন ব্যাপার? বৌ আনতে না আনতে এসব কি হচ্ছে? এরা তো দেখছি খুব নিচু মনের মানুষ। রোকেয়া খুব ছোটলোকের বাড়িতে পড়ল। জীবনে কোনোদিন এতটুকু সুখ শান্তি পাবে না। তখন ভাইপো আজিজের উপর খুব রাগ হল। আবার ভাবলেন, আজিজেরই আর দোষ কি? সে এদের মনের কথা জানবে কি করে? তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। রোকেয়ার শাশুড়ীকে বললেন, তোমরা কেমন মানুষ গো, নাতনির সাথে রাত তিনটে থেকে গাড়িতে বসিয়ে রাখলে, তারপর যদিও বা ঘরে নিয়ে এলে, এতক্ষণ পর্যন্ত একটা পানও দিলে না?
হানুফা বিবি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, কে তুমি? তোমাকে কে চিনে? আমি যা ইচ্ছা তাই করব, তুমি নাক গলাবার কে?
রহিমন বিবি বললেন, বাবারে বাবা, শুনেছিলাম, রোকেয়ার শাশুড়ী একদম সোজা মানুষ। এমন কি কেউ কোনোদিন তার গলা পর্যন্ত শুনেনি। এখন দেখছি আর উল্টো। রোকেয়া শাশুড়ীর সঙ্গে চলবে কি করে? এই ঘরে দিন গুজরান করবে কি করে?
হানুফা বিবির এক বোন ভাগনার বিয়েতে এসেছেন। তিনি সেখানে ছিলেন। বলে উঠলেন, উনি কি বৌয়ের নানি? না বৌয়ের সাথে বাদী হয়ে এসেছে?
রহিমন বিবি মনে খুব আঘাত পেলেন। ভাবলেন, এরা শুধু ছোট লোক নয়, খুব নিচু শ্রেণীর ছোটলোক। এদেরকে একটা কথা বললে সাতটা শুনিয়ে দেয়। তাই তিনি আর কোনো কথা না বলে চুপ করে গেলেন।
রোকেয়া ঘোমটা দিয়ে বসে বসে সবকিছু শুনছে আর চোখের পানি ফেলছে। এভাবে সারাদিন কেটে গেল। অবশ্য এক টাইম নাস্তা এবং দুটাইম ভাত তারা খাইয়েছে। রহিমন বিবির এখানে কিছু মুখে দিবার ইচ্ছা ছিল না। সে না খেলে রোকেয়াও খাবে না জেনে অল্প কিছু খেয়েছেন। আর রোকেয়ার কেঁদে কেঁদে পেট ফুলে গেছে। সে আর কি খাবে। তবু নানির জেদাজেদীতে দুচার গাল খেয়েছে।
রাতে রোকেয়াকে বাসর ঘরে নেওয়া হল। সাথে হারুনের দুজন চাচাতো ভাবি ছিল। তারা অনেক ঠাট্টা মস্করা করে এক সময় চলে গেল। রোকেয়ার একা একা বেশ ভয় করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর হারুন এসে তার পাশে বসে রোকেয়ার একটা হাত ধরে বলল, রোকা, তুমি খুব ভয় পেয়েছ না? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কত সাধনার পর তোমাকে পেয়েছি। যেই যা তোমাকে বলুক না কেন, তুমি কিছু মনে করবে না। আমি ঠিক থাকলে আল্লাহর রহমতে কেউ কিছু করতে পারবে না। তারপর তার ঘোমটা খুলে দিয়ে বলল, তোমাকে দেখার জন্য কতদিন রাস্তার ধারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছি, কখন তুমি স্কুলে যাবে এবং আসবে। আমাকে খারাপ ছেলে ভাবতে পার ভেবে, ঐ একদিন ছাড়া আর কোনোদিন তোমার সামনে যাইনি। আজ আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় প্রাণ ভরে দেখব। কই মুখ তুলে আমার দিকে তাকাও তো।
স্বামীর কথা শুনে রোকেয়ার ভয় কেটে গেলেও লজ্জায় মাথা নিচু করেই রইল।
রোকেয়াকে ঐ অবস্থায় থাকতে দেখে হারুন বলল, আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়নি? না হলে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?
রোকেয়া আর চুপকরে থাকতে পারল না। মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে বলল, এমন কথা বলবেন না। আপনাকে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি। তারপর স্বামীর দুপায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে বলল, সেই আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া জানাই, যিনি আমাকে আপনার মোবারক কদমের সেবা করার সুযোগ দিলেন।
হারুন তাকে দুহাত জড়িয়ে ধরে তার দুগাল চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, সত্যি রোকা, তোমাকে পেয়ে আমিও ধণ্য হলাম। সে জন্যে আমিও আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি।
হারুন জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে রোকেয়াও তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সে থেমে যেতে বলল, আমি কি আপনার ভালবাসার প্রতিদান দিতে পারব?
হারুন তাকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে বলল, কেন পারবে না? নিশ্চয় পারবে। আমাদের উপর সংসারের ব্যাপারে যত বড় তুফান বয়ে যাক না কেন, আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসে সেসব সহ্য করে যাব। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলছি মন দিয়ে শোন। যদি তুমি আমার কথাগুলো মনে রেখে সেই মত চল, তাহলে ইনশাল্লাহ আমাদের জীবনে কোনো অশান্তি প্রবেশ করতে পারবে না। জানতো সব মানুষ সমান হয় না। আল্লাহ মাফ করুক, আমি আমার আম্মার বদনাম করছি না, তোমাকে বোঝাবার জন্য বলছি। তুমি বোধহয় শুনেছ, তোমাকে আমার আম্মার পছন্দ হয়নি। সেই জন্য বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল। আমি মায়ের অমতে তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি। তাই তুমি তার কথামত চলে, তারও আব্বার সেবা যত্ন করে আম্মাকে সন্তুষ্ট করবে। আমি প্রথম সন্তান। আমার ও তোমার উপর তাদের অনেক আশা ভরসা। আম্মার দোষ কোনোদিন ধরবে না। সংসার ক্ষেত্রে অনেক সময়। অনেক কিছু হবে। তুমি সে সব নীরবে সহ্য করবে। তুমি ঘরের বড় বৌ। সবাই তোমার কাছে নানা রকম আবদার করবে। তাদের আবদার সাধ্যমত পূরণ করার চেষ্টা করবে। তারপর হারুন স্ত্রীর দুটো হাত নিজের দুগালে চেপে ধরে বলল, রোকা, আমার কথাগুলো মনে রাখবে তো?
রোকেয়া বলল, ইনশাআল্লাহ রাখব। আপনি দোওয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আমাকে আপনার কথামত চলার তওফিক দেন।
হারুন তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, করব কি? এখনই করছি। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে দুহাত তুলে মোনাজাত করল, আল্লাহপাক, তোমার ইশারাতেই কুল মখলুকাত পরিচালিত হচ্ছে। তুমি সমস্ত সৃষ্টি জীবের মনের কথা জান। তুমি আমার ও আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর মনের সমস্ত নেক মকসুদ পূরণ কর। আমাদের সাংসারিক ও দাম্পত্য জীবনে তোমার রহমত বর্ষণ কর। আমার প্রিয়তমা রোকাকে এবং আমাকে সংসারের সব রকমের অশান্তি সহ্য করার তওফিক দাও। আমাদের সব রকমের গোনাহ মাফ করে সদা সত্য পথে চালিত কর। তারপর আমিন বলে মোনাজাত শেষ করল।