মেয়ের হাত থেকে কনকাঞ্জলি নিয়ে মা আর ফিরে তাকাননি। নিয়মও ছিল না। এক রাতের মধ্যেই তিনি বুঝেছিলেন কার হাতে মেয়েকে তুলে দিলেন শেষ পর্যন্ত। নিজের স্বামীকে বেশি কিছু বলতে পারনেনি। এমনকি দায় চাপাতেও না। কারণ তিনি জানতেন তাঁর মেয়ে দিন-দিন একটা আগুনের গোলা তৈরী হচ্ছে। ওই রূপ এই পাড়া গাঁয়ে, খাল বিল পুকুরের পাশে, শাপলা গন্ধরাজের মতো যত ফুটে বেরোবে, তত বাড়ির বিপত্তি বাড়বে। এমনিতেই রাত বিরেতে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। এগিয়ে গিয়ে দেখেন দরজার হুড়কো ভালো করে দেওয়া আছে কিনা। বাড়িতে আগুন রাখলে তার সাথে যে পর্যাপ্ত জলও রাখতে হয় সেটা মনে করেই হাত পা সিঁধিয়ে যেত তাঁর। পাশের গ্রাম থেকে মনিরুল মাঝে মাঝেই আসতো ইন্দুবালার কাছে পড়া দেখতে। সমবয়সী তারা। এক্কেবারে পছন্দ হতো না মায়ের। ইন্দুবালা সেটা বুঝতেন। কিন্তু মনিরুলকে খুব মিষ্টি লাগতো তাঁর। গুটি আমে সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, চিনি মাখিয়ে খেলে যেমন মনিরুল ঠিক তেমন। লজ্জায় মুখে লাল হয়ে যায় ইন্দুবালার। এইসব কী ভাবছেন তিনি? তড়িঘড়ি বাইরের দাওয়ায় আসন পেতে, কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে বসতে দিতেন মনিরুলকে। এই বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ির বাধ বিচার তেমন না থাকলেও মনিরুলের জায়গা কোনোদিন বাড়ির অন্দরে হয়নি। হতোও না কোনো কালে। যদিও ধর্ম-জাত এইসব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাতেন না দাদু। কিন্তু বাবা মা ছিলেন উলটো পথের পথিক। ছুত্সর্গের বাছ বিচার যে কত দূর যেতে পারে তা ইন্দুবালা দেখেছিলেন কলকাতায় এসে। শাশুড়ির সংসারে। তার জীবন থেকে সবাই চলে যাবার পর ইন্দুবালা এই সব এঁটো কাটা পরিষ্কার করেছিলেন দু হাত দিয়ে। তাঁর কাছে মানুষ মানে ছিল জীব। তিনি পেট ভরে খাইয়ে জীবে প্রেম করতেন।
মনিরুলের তখন সদ্য গোঁফ উঠেছে। কেষ্ট ঠাকুরের মতো বাঁশি বাজায়। চোখ গোল গোল করে বাতাবি লেবু গাছের তলায় চন্দ্রবোড়ার বাসার গল্প করে। নৌকায় দাঁড় বেয়ে নিয়ে যায় পাশের গ্রামে। শুধু তাই নয় সুর করে মাঝে মাঝে কবিতাও বলে …
“আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নীরবে বসিয়া কোন কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি।
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি
কোন সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি!”
‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এ সাজু আর রুপাইয়ের করুণ পরিণতি বারবার যেন শুনতে চান ইন্দুবালা মনিরুলের কণ্ঠে। জসীমউদ্দিন যে তাঁর বড় ভালোলাগা কবি। বাবার কাছে কত গল্প শুনেছেন। একবার যখন ইন্দুবালা খুব ছোটো, এই গ্রামে এসেছিলেন নাকি কবি। তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে চিড়েভাজা খেয়েছিলেন। ঠাম্মা দিয়েছিল কোঁচড় ভরা নাড়। আমসত্ত্ব। তাল পাটালি। মনিরুলের এইসব গল্প শুনতে ভালো লাগে। আর ইন্দুবালার ভালো লাগতো মনিরুলের গলায়, ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ শুনতে। চোখ ভিজে আসে সাজু আর রূপাইয়ের দুঃখে। ঝি ঝি ডেকে ওঠে। ঠাম্মা চুপ করে সলতে পাকান। ভাই কবিতা শুনতে শুনতে হাঁ করে বসে থাকে সবে সন্ধ্যে নামা কলাপোতার মাটির বাড়ির দাওয়ায়। দূরে আজানের শব্দ ভেসে আসে পাশের বাড়ির সন্ধ্যের শাঁখে। চেয়ে থাকেন ইন্দুবালা মনিরুলের দিকে। কবেকার মনিরুল তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সহজ সরল টানাটানা চোখে তাকায়। আর এদিকের সত্তর পেরোনো ইন্দুবালা যেন একটুও নড়তে পারেন না বিছানা থেকে। চুপ করে শুয়ে থাকেন। উনি জানেন এই ঘোরটুকু নিয়েই এখনও বেঁচে আছেন। যেদিন এই ঘোর কেটে যাবে, সেদিন তিনিও চিরকালের মতো ছেনু মিত্তির লেন ছেড়ে কোথায় কোন দূরের পথে পা বাড়াবেন।
ধনঞ্জয় নীচ থেকে ডাকছে। তাকে বাজারের টাকা দিতে হবে। ফর্দ করতে হবে। কিন্তু আজ তাঁর যেন কিছুই শুনতে ইচ্ছে করছে না। কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। বর্ষার বেলা গড়াচ্ছে, তিনি চুপটি করে শুয়ে আছেন। কারণ ওদিকে মা গ্রামের সেই সন্ধ্যে হয়ে আসা ভালোবাসার পরিবেশে শুধু শুধু তাড়া লাগাচ্ছে। মা বুঝতে পারছেন লক্ষণ ভালো না। আগুনের গোলা হয়ে উঠছে মেয়ে। সবার চোখ তার দিকে। এমনকি এই একরত্তি ছেলেটারও। শেষকালে কিনা মেয়ে বিধর্মী হবে? বাড়ি থেকে পালাবে? কিংবা পাশের গ্রামের স্বর্ণলতার মতো দেহটা ভেসে উঠবে পুকুরে? ছেলেটাকেও তো ছাড়েনি বাড়ির লোকেরা। ধান ক্ষেতে কুপিয়ে রেখে দিয়েছিল। ভাবতে পারেন না আর। একটা ছোট্ট ভুলের জন্য বেঘোরে যাবে দুটো প্রাণ। ছোট্ট ভুল? হ্যাঁ তাই তো। কবে আর কার জীবনে ভালোবাসা অনেক বড় হয়ে এলো? আর যদি আসতোই তাহলে চারপাশটা পালটে যেত না খুব তাড়াতাড়ি? মুখ দিয়ে বেরিয়েই যায় “এবার তুই উঠে পড় মনিরুল। অনেকটা পথ যাবি। তোর মায়েরও তো চিন্তা হয় তাই না?” কথাগুলো বলতে পেরে যেন শান্তি পান ইন্দুবালার মা। মনিরুল গুছিয়ে নেয় তার বই। ব্যাগ। হাতের বাঁশি। লণ্ঠন নিয়ে উঠোনটা পার করে দিয়ে আসেন ইন্দুবালা। দাঁড়িয়ে থাকেন বেড়ার দরজায়। যতক্ষণ না মনিরুল সামনের আলটা পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলেন কি মনিরুলকে ইন্দুবালা? বেসেছিলেনই তো। না হলে কে লুকিয়ে লুকিয়ে মনিরুলের জন্য নাড় নিয়ে যেত? মুড়ির মোয়া। কুলের আচার। গপ গপ করে ছেলেটা খেত। আর এক টানা গল্প করে যেতো। কত যে গল্প ছিল মনিরুলের ওই ছেঁড়া কাপড়ের ব্যাগে ঠাহর করতে পারতেন না ইন্দুবালা। তাহলে কেন কোনোদিন মনিরুলকে নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলতে পারেননি? ভয় করেছিল তাঁর? নাকি বড় অভিমান করেছিলেন। মনিরুলের ওপরে? মা আসতে বারণ করেছিল মনিরুলকে। তাই বলে সে আর এই পথই মাড়াবে না? স্কুলেও কথা বলবে না? লুকিয়ে লুকিয়ে থাকবে সব সময়? চোখ ফেটে জল আসতো ইন্দুবালার। টিফিন কৌটোতে পড়ে থাকতো আমলকি, নলেন গুড়ে পাকানো রুটি। তারা যে এক সাথে বসে দুজনে খেত। সে কথা কি মনিরুল ভুলে গেছে? খিদে পায় না বুঝি ইন্দুবালার? একদিন স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিল মনিরুল। কারা যেন রটিয়ে দিল কলাপোতার ইন্দুবালার সাথে সাতদিঘি গ্রামের মনিরুলের প্রেম হয়েছে। চিঠিও নাকি পেয়েছে তারা। বাড়িতে বন্দি হলেন ইন্দুবালা। আলের ধারের জানলার কাছে চুপ করে বসে থাকতেন। সন্ধ্যের শাঁখ বাজতো। আজান তার ঠিক সময় মতোই হতো। কিন্তু মনিরুলকে আর আলোর পথে দেখা যেত না। এতটাও কেন ভালোবাসতো মনিরুল ইন্দুবালাকে? যে ভালোবাসার দাম দিতে গিয়ে হারিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে।