অনেক রাত পর্যন্ত কান পেতে থাকতেন ইন্দুবালা। অপেক্ষা করতেন অলোকের জন্য। তার সঙ্গীদের জন্য। সারাদিন ওরা খালি পেটে, পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে বেড়িয়ে অধিকার আদায় করছে। মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। চাড্ডি ভাত-ডালের অধিকার। অপমানিত না হয়ে স্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়াবার অধিকার। ঠুক শব্দ শুনলেই নিজে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেন ইন্দুবালা। ছেলেটা সাতদিনের ভাত একদিনে খেয়ে কোথায় যে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে যেত কে জানে! মজা করে ইন্দুবালা তার একটা ছদ্ম নাম দিয়েছিলেন, প্যাঁচা। প্যাঁচার জন্য রোজ ভাত বাড়া থাকতো। কিন্তু প্যাঁচা রোজ আসতো না। তার আসা সম্ভব ছিল না। রাতের অন্ধকারে শুধু একটা গলা ফিসফিস করে ভেসে বেড়াতো “কমরেড ইন্দুবালা আপনারা থাকলে আমরা থাকবো।” কিন্তু কই। ইন্দুবালা তো আছেন। তাহলে অলোক নেই কেন? সুশান্ত নেই কেনো? গোরা নেই কেন? কৃষ্ণা নেই কেন? প্যাঁচার দলটা যে আর ভাত খেতে আসেনি কোনোদিন। এরও অনেক পরে শুনেছিলেন বরানগর ঘাটে পিচ আর ব্লিচিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল রক্ত। অলোকের দেহটা দুবার নড়ে উঠে স্থির হয়ে গিয়েছিল সেদিন। চোখদুটো খোলা ছিল আকাশের দিকে। তারায় ভরা আকাশ দেখছিল কি অলোক? নাকি বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন শহর জুড়ে? ধুয়ে যাচ্ছিল রক্ত। মিশে যাচ্ছিল গঙ্গার জলের সাথে। ভেসে চলছিল নিথর দেহগুলো ঢেউয়ের তালে তালে সপ্ত ডিঙার মতো। অজানা এক স্বপ্নে। সত্তরের দশক মুক্তির দশক হতে পেরেছিল কিনা ইতিহাস তার মূল্যায়ন করেনি কোনোদিন। করবে কিনা তাও জানা যায় না। কিন্তু সেদিনও এক বিধবা হোটেল মালিক হাঁড়িতে কিছুটা চাল বেশি নিয়েছিলেন। যদি ফিরে আসে ছেলে-মেয়েগুলো। যদি তার কাছে এসে আবার ভাত চায়। অপেক্ষায় ছিলেন রাতের পর রাত। কিন্তু তারা কেউ ফেরেনি।
কেউ যেন একটা হাত ধরে ইন্দুবালার। ছানি না পাকা ঘোলাটে চোখে সামনে তাকান তিনি। কিংশুক দাঁড়িয়ে। পাশে সুজিত। আরও পেছনে ইন্দুবালার সব চাঁদপানারা। “দেখবে না দিদা তোমার বোর্ডে কী লিখেছি? তারপরে তুমি ডিসিশান নিও এইগুলো আজ রান্না করবে নাকি করবে না”। ওরা দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। ইন্দুবালা কি আর অত তড়বড় করতে পারেন? হাঁটুর ব্যথা, গেঁটে বাত নিয়ে এক দঙ্গল ছেলের সঙ্গে যখন সেই কবেকার কালো সিমেন্টের বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ান তখন তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে ভাদ্রের বৃষ্টির মতো। কবেকার অলোক, গোরা, সুশান্ত, কৃষ্ণা যেন কিংশুক, সুজিত, রূপম, সাবেরের হাত ধরে এসে লিখে গেছে তার বোর্ডে। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের আজকের মেনুতে জ্বলজ্বল করছে ভাত, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত, কালো জিরে দিয়ে পার্শে মাছের ঝোল, বিলাতি আমড়ার চাটনি। ইন্দুবালা জানেন এরপর তিনি আর স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না। যতক্ষণ না ছেলেগুলোর মুখে হাপুস হুপুস শব্দ ওঠে। যতক্ষণ না সারা বাড়ি ছড়িয়ে যায় বিউলির ডালে মৌরি ফোড়নের গন্ধে। পার্শে মাছে কালো জিরের পাশে কাঁচা লঙ্কার আবেশ করা ঝোলে। আলু পোস্তর একটু কাঁচা তেলের সুবাসে। বিলাতি আমড়ার টকে সর্ষের মনকাড়া তীব্র ঝাঁঝে। টেবিলে কলাপাতা পাতা হয়। মাটির গ্লাসে জল। লেবু, নুন, লঙ্কা। এক পেট খিদে আর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কবেকার হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের হয়ে এখনকার প্রজন্ম ভাত খায় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। ইন্দুবালা আজও বিশ্বাস করেন অতিথির কোনো ধর্ম হয় না। বর্ণ হয় না। জাত, গোত্র কিছু না। অতিথি হন ঈশ্বর।
৩. ছ্যাঁচড়া
কোনো এক আষাঢ়ের সকালে জন্ম হয়েছিল ইন্দুবালার। মায়ের মুখে শুনেছিলেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি বেয়ে বৃষ্টির জল ঢুকেছিল আঁতুড় ঘরে। জল থইথই মেঝেতে সদ্য জন্মানো শিশুটি সাঁতার কাটছিল যেন। ঠাম্মা কোলে তুলে নিতেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। “এমন চাঁদপানা মুখ তুই পেলি কোত্থেকে এই বংশে”? সোহাগ করে নাতনির নাম রাখলেন ইন্দুবালা। তারও বছর পাঁচেক পরে মাঘের কুয়াশা ভরা ধান ক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে বাবার হাত ধরে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। শুধু এইটুকু মনে আছে ফুল ফুল ছাপ একটা ফ্রক পরেছিলেন। গায়ে ছিল মায়ের বোনা সোয়েটার। মাথায় উলের টুপি। ঠাম্মার কাছে শোনা রূপকথার রানী বলে মনে হচ্ছিল সেদিন নিজেকে। ঠাকুরদার টোলটা তখনও চলছে টিম টিম করে। সেই টোলে বর্ণপরিচয়, ধারাপাত এইসব টুকটাক শিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন সেখানে পড়া হলো না। আমের গাছে মুকুল ভরিয়ে, সরস্বতী পুজোয় হাতেখড়ি দিয়ে দাদুর বড্ড তাড়াতাড়ি ছিল হয়তো এক্কেবারে চলে যাওয়ার। শিশিরে ভিজেছিল টোলের রাস্তাটা। সেদিন কেউ আর দাওয়া ঝাঁট দেয়নি। উঠোন লেপেনি। পাশের মুকুল ভর্তি বুড়ো আমগাছটা কাটা হয়েছিল দাদুর সৎকারের জন্য। ঠিক এর পরেই দুটো গাঁ পেরিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন ছোট্ট ইন্দুবালা। পড়াশুনোয় তাঁর বেজায় মন ছিল। দাদু সেই ছোট্টবেলাতেই তাঁকে স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইয়া বড় বাড়ি। সামনে কত কত গাড়ি। বেণী দুলিয়ে, শাড়ি পরে ইন্দুবালা কলেজ করছে। এমন একটা ঝাপসা ছবি যেন আলপনার মতো আঁকা থাকতো মনে। ওইটুকুনি মেয়ে এত সব কিছু যে বুঝতো তেমনটা ঠিক না। শুধু অনেক দূরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতো। এক্কা-দোক্কা, লুকোচুরি, খেলনা বাটির বয়েস পার করে ইন্দুবালা প্রবেশ করলেন এবার হাইস্কুলে। সেখান মেয়ে বলতে হাতে গোনা ওই কজন। মাঝের পাড়া, পুবের গাঁ আর কলাপোতা মিলিয়ে মেয়ের সংখ্যা তেমন একটা ছিল না। থাকবেই বা কী করে? সবাইকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিতো না বাড়ির লোকজন। ছেলের পালের মধ্যে মেয়ে বসবে শুনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতো অনেকের। ইন্দুবালার মা’র পছন্দ ছিল না স্কুলটা। কোনোদিনই। বাড়িতেই তো পড়াশুনা করা যায়। অনেক বার সে কথা বলেছেন স্বামীকে। কিন্তু যার বাবার টোল ছিল, যে নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কালে পড়াশোনা করেছে; কিন্তু ভাগ্যের ফেরে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে এসে সংসারে হাত লাগিয়েছে, সে তার মেয়েকে পড়াবে না তা হতে পারে। তাই লেখাপড়া, স্কুলে যাওয়াটা চলছিল ইন্দুবালার দিনের অন্যান্য কাজের মতোই। সেটাও অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মায়ের খানিকটা চিল চিৎকারেই হোক, আর চারপাশের পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যাওয়ার কারণেই হোক কোনো এক সূত্র ধরে বাবা চিঠি লিখেছিলেন তাঁর বনগ্রামের এক বন্ধুকে। কন্যার বিবাহ তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করিতে চাই। ভালো পাত্ৰ থাকিলে জানাইও’। সেখান থেকে উত্তর পেতে দেরি হয়নি। ছেলে একেবারে ‘মাস্টার। নিজেদের দোতলা বাড়ি। বনেদী বংশ। বন্ধুর বিশেষ পরিচিত। শুধু একটু খুঁত আছে। “খুঁত?” ঠাম্মা সেদিন বাড়িতে তালের ভাপা পিঠে করেছিলেন। গ্রামে অষ্ট প্রহরের জন্য বাড়িতে ছিল নিরামিষ রান্না। হাঁড়িতে সেদিন বসেছিল আতপ চালের খিচুড়ি। আলুগুলো ডুমো ডুমো করে কাটা ছিল। বাগান থেকে ইন্দুবালা তুলে এনেছিলেন অসময়ের কাঁচা টমেটো। নামানোর আগে ঠাম্মা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন হরিমতির দুধে তোলা বাড়ির ঘি। কলাপাতায় ঘিয়ের গন্ধ ওঠা খিচুড়ি খেতে বসে ‘দোজবরে’ শব্দটা জীবনে প্রথম শুনেছিলেন ইন্দুবালা। ছাদনা তলায় ছেলেকে দেখে ডাকাত মনে হয়েছিল তাঁর। ইয়া গোঁফ, বাবরি চুল। চোখ লাল টকটকে। দাঁতগুলো খয়েরের ছোপে মলিন। নিশ্বাসে দুর্গন্ধ। ছেলে বরণ করে এসে এই প্রথম মা বাবার হাত ধরে জানতে চেয়েছিলেন “সব খবর নিয়ে দিচ্ছো তো মেয়েকে? গা দিয়ে যে গন্ধ বেরোয়। সবাই ফিসফিসাচ্ছে। বলছে মাতাল বর”। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসর ঘরে কড়ি খেলা শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই বউয়ের পাশে দোজবরে স্বামী ঘুমে ঢলে পড়লে ইন্দুবালা ভালো করে তাকিয়েছিলেন লোকটার মুখের দিকে। হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিক। নাক ডাকার চোটে বাইরে এসে বসেছিলেন ইন্দুবালা। চারিদিকের অন্ধকারে সেই শেষবারের মতো জোনাকিগুলো যখন আলো জ্বালিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরলো তখন নিজেকে আর সামলাতে পারেননি তিনি। ভেঙে পড়েছিলেন। একটা মেয়ে তার যাবতীয় শেষ স্বপ্নটুকু নিয়ে কাঁদছে। তার সাক্ষী কোনো কাছের মানুষ ছিল না সেদিন। কোনোদিনই অবশ্য থাকেনি ইন্দুবালার পাশে কেউ। কিন্তু জামগাছটা ছিল। তুলসীতলা ছিল। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠে আমগাছটা যেন ডালপালা নেড়ে বলেছিল “কাঁদিস না ইন্দুবালা। একটুও কাঁদিস না। এটা তোর নিয়তি”। এরপর ইন্দুবালার আর কোনোদিন বসা হবে না নিজের বাড়ির এই দাওয়ায়। ফেরা হবে না জন্মভূমিতে। কলাপোতা গ্রামটা সশরীরে মুছে যাবে তার ভৌগোলিক স্থাবর অস্থাবর সব কিছু নিয়ে। ইন্দুবালার শুধু মনে রয়ে যাবে এক অলৌকিক অনুভূতি। দেশ নামের স্পর্শ না করা এক স্বপ্নকে।