বড় বেতের ঝুড়ি দিয়ে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকতো রান্নাঘরে। অনেক রাতে শহর নিশুতি হলে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের পেছনের দরজায় কড়া পড়তো একবার। ওটা সাংকেতিক শব্দ। মানে “জেগে আছো কমরেড ইন্দুবালা?” “কমরেড? সেটার আবার কী মানে?” অলোক ফস করে সিগারেট জ্বালায়। “বন্ধু …সাথী..সহযাত্রী…সহযোদ্ধা…এক এক সময় এক এক রকমের মানে। আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। তা না জেনে আমাদের খাওয়াচ্ছেন কোন সাহসে? গোটা শহর আমাদের কী বলে জানেন?” ইন্দুবালা ঘাড় নাড়েন, না জানেন না। অলোক শিড়দাঁড়া সোজা করে বলে “নকশাল”। ইন্দুবালার চকিতে মনে পড়ে যায় অলোকের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনের কথা। সবেমাত্র হাতের সব কাজ সেরে হোটেল বন্ধ করে দোতলায় উঠবেন। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন। ধনঞ্জয় সে সময়ে কয়েকদিনের জন্য দেশে গেছে। হাওয়ার শব্দ ভেবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দোতলার সিঁড়ির দিকে ইন্দুবালা। কিন্তু আবার শব্দটা হলো। হ্যাঁ এবার স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন তিনি। থমকে দাঁড়াতেই হলো। রান্নাঘরের পেছনের দরজার দিক থেকে আসছে শব্দটা। ওদিকটায় বাগান। বাগানের শেষে পাঁচিল। লোকজন আসবার হলে সামনের দরজা দিয়ে আসে তারা। পেছনের দরজা সচরাচর কেউ ব্যবহার করে না ইন্দুবালা আর ধনঞ্জয় ছাড়া। তাহলে কি অন্য কেউ? কোন মতলবে? সেই সময়ে ইন্দুবালার বাড়ি নিয়ে শরিকি ঝামেলা তুঙ্গে। স্বামী নেই, শাশুড়ি নেই, মাঝে মাঝেই কেউ না কেউ বাড়িতে এসে হম্বিতম্বি করে চলে যায়। একলা বিধবা পেয়ে লিখিয়ে নিতে চায় সবকিছু। প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারাই আবার গুণ্ডা পাঠালো না তো! আঁশ বটিখানা হাতে তুলে নেন ইন্দুবালা। একটাকে শেষ না করে আজ নিজেও শান্তি পাবেন না। তারপর না হয় বাচ্চাগুলোকে সঙ্গে করে নিজেই যাবেন থানায়। আর নিজে মরে গেলে তো শেষ হয়ে গেল সব কিছু। পরক্ষণেই মনে হয় তাহলে বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে? ওরা যে বড্ড ছোটো। নিজের মারা যাওয়ার চিন্তাটাকে আপাতত সরিয়ে রাখেন ইন্দুবালা। মনে প্রচণ্ড সাহস জুগিয়ে এগিয়ে যান দরজার দিকে। “কে? কে ওখানে?” উত্তর আসার বদলে আবার একবার কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। আর নিজেকে সামলাতে পারেন না ইন্দুবালা। রাগের মাথায় খুলেই ফেলেন দরজা। “আয় তোদের শেষ করবো আজকে আমি”। কিন্তু সেই লোডশেডিং-এর রাতে সামনে এরা কারা? বাগানের মধ্যে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে সব। নড়েও না, চড়েও না। কুপিখানা তুলে ধরেন ইন্দুবালা। আর ঠিক তখনই আলোছায়ার মধ্যে উপলব্ধি করেন এরা তো গুণ্ডা নয়। তার চারপাশে জ্ঞাতি কুটুমদের মতো সম্পত্তি লোভী কুলাঙ্গার নয়। চোখগুলো ভাসা ভাসা যেন কোনো এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সবচেয়ে রোগা ছেলেটা এগিয়ে আসে। “কিছু মনে করবেন না। এতো রাতে বিরক্ত করলাম আপনাকে। আমার নাম অলোক। আর এরা আমার বন্ধু। আমাদের একটু খেতে দেবেন? দু-দিন কিছু খাওয়া হয়নি।” অনেক রাতে ভাত বসিয়েছিলেন ইন্দুবালা। সাথে ছিল একটু আলু পোস্তর চচ্চড়ি। চেটেপুটে খেয়ে চলে গেল ছেলে মেয়েগুলো। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আসতে থাকলো অনেক রাতে। কখনও অলোক একা। অথবা সঙ্গে করে দু তিনজনকে নিয়ে। ওরা খাবারের পয়সা দিতে পারতো না। চাইতেন না ইন্দুবালা কোনোদিন। কিন্তু একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন নিজের চারপাশ জুড়ে। আর বদমায়েশ আত্মীয়রা তার ওপর খবরদারি দেখাতে আসতো না। ভয় দেখাতে তো নয়ই। বরং তাঁকে দেখলে সরে পড়তে টুপটাপ। লছমী কোথা থেকে খবর এনে দিল, “আচ্ছাসে ওদের ডরা দিয়া মাজি তোর ওই ছেলে মেয়ে গুলো। তুইও সাবধানে থাকিস। ওরা নকশাল আছে। কখন আবার পুলিশ আসে।” কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ইন্দুবালার গা। “নকশাল”? আজকেই তো কালেক্টর অফিসের কেরানিরা খেতে এসে কি সব ফিসফিস করে আলোচনা করছিল। “কটা ছেলে মারা গেছে। গঙ্গার ঘাটে বোমা। সব নকশাল … নকশাল…। বিপ্লব করে দিন দুনিয়া পালটে দেবে”।
অলোক তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। “এইবার তো জেনে গেলেন আমরা কে? নিশ্চই এর পরের বার থেকে আর দরজা খুলবেন না।” ইন্দুবালা কি সেদিন কিছু বলতে পেরেছিলেন? নাকি তার চোখ ভারী হয়ে আসছিল জলে। মনে পড়ে যাচ্ছিল ভাইয়ের কথা। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র গড়ার দাবিতে সেও তো তখন মুক্তি যোদ্ধা। অনেক দিন পরে লুকিয়ে বাড়িতে এসেছিল দুটো ভাত খাবে বলে। মাও সেদিন বেড়ে দিয়েছিল গরম ভাত। প্রথম গ্রাস মুখে তোলার আগেই বাড়িটা দাউ দাউ করে জলে ওঠে। মাকে, ভাইকে কাউকেই বেরোতে দেয়নি খান সেনারা ওই জ্বলন্ত কুণ্ড থেকে। মালাউন পুড়িয়ে পুণ্য করেছিল তারা। ভাই কি সেদিন চিৎকার করেছিল? নাকি সেই লেলিহান শিখার মধ্যে মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসেছিল? মা কি তাকে সেদিন রাখালের পিঠে খাওয়ার গল্পটা বলছিল? নাকি ঘুম পাড়ানিয়া গান শোনাচ্ছিল সুর করে করে? এগুলো সেই পাগলাটে লোকটার কাছে জানা হয়নি সেদিন। জানতে পারেননি ইন্দুবালা। তার আগেই সে চলে গিয়েছিল। কোথায়? কেউ জানে না। “আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না কমরেড। ধরে নিচ্ছি আপনি আর চান না আমরা এখানে আসি।” দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল অলোক। ইন্দুবালা অস্ফুটে বলেছিলেন, “একদিন রাতে যখন দরজা ধাক্কিয়ে ভাত খেতে এসেছিলে তখন তো জানতে চাইনি কিছু। আজ কেন জানাচ্ছ? মা বলতো অতিথির কোনো পরিচয় হয় না। ধর্ম হয় না। তাঁরা হন ঈশ্বর”। তাকাতে পারেনি অলোক ইন্দুবালার দিকে। সে সাহস তার ছিল না। যদিও দুটো ঘোরেল পুলিশ ইন্সপেক্টর আর গোটা একটা গোয়েন্দা দপ্তরকে সে আদাজল খাইয়ে ঘোরাচ্ছিল সেই সময় কলকাতার রাস্তায়। অলিতে গলিতে। লালবাজারে একজন তাঁদেরও ওপরের লোক হাতে লোহার বেড়ি নিয়ে বসে ছিলেন এইসব বেয়াদপ ছেলে মেয়েদের কাছে নিজের সাদা-কালো আমিকে চিনিয়ে দেবার জন্য। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল তারা। এতো সব দস্যিপনা করা ছেলেটা সেই নিশুতি রাতে এক সহজ সরল গেঁয়ো বাঙাল বিধবার কথার পিঠে কথা জুড়তে পারেনি। শুধু বিড়বিড় করেছিল “ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি না কমরেড। কিন্তু আপনারা থাকুন। আপনারা থাকলে আমরা থাকব।”