সেদিন এমনই ছিল ভাদ্রের আকাশ। ঘরে ছিল গুমোট গরম। দুই ছেলের পর মেয়েটা তখন পেটে। শাশুড়ি আর হাঁটতে চলতে পারেন না। খুবই অসুস্থ। ঘরের বিছানায় শুয়ে সব কিছু। ইন্দুবালা প্রাণপণে সেবা করেন তাঁর এই ভরা অবস্থায়। তখন দুদিন প্রায় খাওয়া নেই বুড়ির। হঠাৎ একদিন সকালে ইন্দুবালার কাছে আবদার করলেন, “বউ একটু বিউলির ডাল রাঁধলে দুটো ভাত খেতে পারতুম”। ইন্দুবালা তাড়াতাড়ি উনুন ধরিয়েছিলেন সেদিন। ডাল সেদ্ধ করে মৌরি ফোড়ন দিয়েছিলেন। নামানোর আগে একটুখানি চিনি। বুড়ি ওঘর থেকে চিৎকার করছিলেন হাঁপ ধরা গলায়। “হলো তোর বউ? আর কত দেরী?” পদ্মকাটা বাটিতে ডাল ঢেলে, কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে যত্ন করে খাইয়েছিলেন শাশুড়িকে। সবটুকু ভাত আর ডাল বিছানার সাথে মিশিয়ে যাওয়া বুড়ি কোথায় যে নিয়ে নিচ্ছিলো ইন্দুবালা নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন না। খাওয়া শেষ হলে বুড়ির চোখ গড়িয়ে নেমেছিল করুণাধারা। আশীর্বাদ করেছিলেন, “সবাইকে এইভাবে খাইয়ে পরিয়ে সুখী রাখিস বউ”। কথিত আছে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের শেষ কথা খনার বচনের থেকেও নাকি ফলপ্রদ। সত্যি তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল ইন্দুবালার জীবনে। না হলে এতগুলো মানুষকে এই বয়সেও খাওয়াতে পারেন? তবে যেটা তিনি এখনও বুঝতে পারেননি মানুষ কী করে জানতে পারে এটাই তার শেষ খাওয়া? না হলে সেই ভাত খাওয়ার পর বুড়ি আর মুখে কুটোটি নাড়েনি সারাদিন। পরের দিন সকাল বেলায় চা নিয়ে শাশুড়ির ঘুম ভাঙাতে গিয়ে শুধু দেখেছিলেন পাঁচিলের গা ঘেষা জানলার দিকে তাকিয়ে আছেন বুড়ি অপলক দৃষ্টিতে। আকাশে তখন ভাদ্রের জল ভরা মেঘ। মা… মা… বলে দুবার ডেকেছিলেন ইন্দুবালা। শেফালীরানী আর কোনোদিন সাড়া দেননি। ছেনু মিত্তির লেনের অনেক পুরোনো বাড়ির মতো ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছেন মনের মণিকোঠায়।
ধনঞ্জয় হাঁপাতে হাঁপাতে দোতলায় আসে। হড়বড় করে বলে যায় কথা। “আমি কত বারণ করলাম। শুনুচি না আমার কথা। ওই ছেলেগুলানরে আরও মাথায় তুলুচি…। তো এমন হউচি”। ইন্দুবালা হেসে পারেন না। ধনঞ্জয়ের ভাষা ঘটি, বাঙাল ওড়িয়া মিলে মিশে একাকার। মাথার চুলগুলো সব সাদা ধবধবে। তাও ছোটো ছোটো করে ছাঁটা। আবার যত্ন করে একটা টিকিও রেখেছে। গামছা ছাড়া অন্য কিছু তিনি পরতে দেখেননি ধনঞ্জয়কে। শীতকালে শুধু গায়ে উঠতো একটা চাদর। তাও খুব জোরাজুরি করার পর। ইন্দুবালার জীবনে যেন অন্ধের যষ্টি এই ধনঞ্জয়। জীবনের নাড়ি নক্ষত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। ধনার কাছ থেকে সবটা শোনার আগেই সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পান ইন্দুবালা। কারা আসছে? এইসময় তো কোনো পুজো নেই। চাঁদার বালাই হওয়ার কথা নয়। আর ছেলে ছোকরাগুলো চাঁদা চায় না তার কাছে। আবদার করে এটা ওটা নিয়ে যায়। কিংবা দুবেলা খেয়ে যায় সবাই মিলে এসে। বড় একটা কেউ দোতলায় ওঠে না নাতি-নাতনি ছাড়া। কিন্তু তাদেরও তো এখন আসার সময় নয়। কিছুদিন আগেই তো সুনয়নীকে ঠেলে পাঠালেন নিজের বাবার বাড়ি। শুনেছেন কোনো কলেজে নাকি পড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে সে এসে পড়লেও এখন তার মোটেই আসার কথা নয়। ইন্দুবালা এগিয়ে যান দোতলার সিঁড়ির কাছে। সামনেই যাকে দেখতে পান, সে কিংশুক। উলটো দিকের মেসে থাকে। কলেজে পড়ছে। মাঝে মাঝেই রান্না খেয়ে দিদা বলে জড়িয়ে ধরে। ফরসা দেখতে। চোখে আবার গান্ধি ফ্রেমের কালো চশমা। শহরে নতুন উঠেছে। আর চাঁদি পর্যন্ত ছাঁটা ফুলকাট চুল। তার ওপরটায় আবার ঢেউ খেলানো বাবড়ি। বড় ভালো লাগে এমন সব আজব সাজগোজ দেখতে ইন্দুবালার। ছেলেটা দোতলার একেবারে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়ায়। ধনঞ্জয় তেড়ে আসে। এরপর সে এগোতে দেবে না কাউকে। হড়বড় করে বলে যাওয়া কথায় যেটুকু বোঝা যায় কিংশুক হোটেলের সামনে টাঙানো কালো বোর্ডের লেখা মুছে দিয়েছে। যেখানে প্রতিদিনের মেনু লেখা থাকে। ইন্দুবালা বলেন “এ তো ভারী অন্যায় কিংশুক। আমার লেখা মোছো কী করে?” কিংশুক তখনও হাঁপাচ্ছে। তার সদ্য তারুণ্য হার মানতে শেখার নয়। “শোনো দিদা। সত্যি বলছি। আমি তো ছিলামই না কয়েকদিন। বাড়ি গিয়েছিলাম। কাল লাস্ট ট্রেনে বর্ধমান থেকে ফিরেছি। মুড়ি জল খেয়ে শুয়ে পড়েছি…। না না প্লিজ তুমি আগে আমার কথা শোনো। আজ সকালে উঠে দেখি ইন্দুবালা ভাতের হোটেল রান্না হবে কচুর ডালনা, মুসুরির ডাল, আর ট্যাঙরা মাছ? এ কেমন কথা দিদা? আজ সুজিতের জন্মদিন ও খাবে কী? এ্যাই সুজিত তুই আবার রূপম, সাবেরের পেছনে লুকোচ্ছিস কেন? এদিকে আয়”। পেছনের ছোট খাটো ভিড় ঠেলে যে ছেলেটা এগিয়ে আসে তাকে দেখে চমকে ওঠেন ইন্দুবালা। কোঁকড়ানো চুল। গালে হালকা দাড়ি। কালো বার্নিশে গায়ের রঙ। হাসলে টোল পড়ে গালে। চোখে শুধু চশমাটুকু নেই। এতোদিন পরে এইভাবে কেউ ফিরে আসে? সত্যি কি আসা যায়? তিনি শুধু জানেন অলোক কোনোদিন ফিরবে না। ফিরতে পারে না। কারণ অলোকের বুক ফুড়ে ঢুকে গিয়েছিল পাঁচ-ছটা গুলি। তার দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশের জিপ। অন্ধকারে ডুবে থাকা এই কলকাতা শহর শুধু সাক্ষী ছিল তার। “কী হলো দিদা? কথা বলছো না কেন?” কিংশুক সমেত ছেলেদের দলটা তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। “সুজিতকে আগে কখনও তো দেখিনি”। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন ইন্দুবালা। কিংশুক হেসে ফেলে। “ও এই কথা … তা দেখবে কী করে? ওকে তো হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।” হো হো করে হেসে ওঠে ছেলের দল। আর যে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন ইন্দুবালা অপলক দৃষ্টিতে যেন বহু যুগের ওপার থেকে সে যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। স্টুডেন্ট হোস্টেলের খাবার নিয়ে আন্দোলন করছিল বলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাড়িয়ে দিয়েছে সুজিতকে। ছেলেটা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো ইন্দুবালাকে। এমনিতে কারও প্রণাম নিতে চান না তিনি। কিন্তু আজ নিলেন। কেন নিলেন নিজেও ঠিক জানেন না। আপত্তি করার সময় হয়তো দেয়নি ছেলেটা। শুধু মনে মনে ইন্দুবালা জানতে চাইলেন, “অমন ভাসা ভাসা চোখ নিয়ে এতোদিন পরে ফিরে এলে কেন অলোক?”