ইন্দুবালার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে পুজো-আচ্চা হতো বেশি। শনি নামের যে এক দেবতা আছে, তার যে প্রত্যেক শনিবার পুজো হয় ইন্দুবালা এখানে এসে তার কথা সঠিক ভাবে জানতে পারেন। সেদিন বাড়িতে নিরামিষ। শাশুড়ি বউয়ের উপোস। সন্ধ্যেবেলা বারের পুজো দিয়ে তার প্রসাদ উঠোনে দাঁড়িয়ে খেয়ে তবে উপোস ভাঙতো। এছাড়াও শাশুড়ি ছেলের মতি গতি ফিরিয়ে আনার জন্য নানা মন্দিরে হত্যে দিতেন। পাঁজি ধরে ধরে করতেন নানা নিয়ম উপাচার। পূর্ণিমায় রাধারমণের মন্দিরে দেওয়া হতো বাতাসার হরির লুঠ। অমাবস্যায় সিদ্ধেশরীর মন্দিরে পোয়াটাক চাল ডালের অন্নভোগ। এইসব কর্মকাণ্ড তিনি একা কখনই করতেন না। ছেলের নতুন বউকে সঙ্গে নিতেন। পাখি পড়ানোর মতো সব কিছু শেখাতেন। খুব কঠিন নিয়মে বেঁধে রাখতেন। ইন্দুবালার গ্রামে ষষ্ঠী, ওলাইচণ্ডী, পুণ্যি পুকুর ব্রতে এত অনুশাসন ছিল না। চাপড়া ষষ্ঠীতে কাঁঠাল পাতার ভেতরে গুড় আর কলা দিয়ে মাখা আটার সিন্নি খেতে দিব্যি লাগতো। বাড়িতে হতো খুদ চালের পায়েস। এইসব কথা শুনলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা হাসাহাসি করতো। তাচ্ছিল্যের নামে অপমান করতো। সেসব গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। পূর্ণিমা-অমাবস্যায়, তিথি নক্ষত্রের ফেরে ভালো দিনে ইন্দুবালাকে সঙ্গে নিয়ে মানুষে টানা রিক্সায় গঙ্গা স্নানে যেতেন শাশুড়ি। প্রথম দিনের ঘটনা আজও মনে আছে ইন্দুবালার। স্বামী ডেকে এনেছেন এমন এক জিনিস যা দেখতে আধভাঙা ঢাকাওয়ালা গাড়ির মতো। সামনে টানা দুটো শুড়ের মতো লাঠি। তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা সিঁড়িঙ্গে মতো লোক। তার হাতে একটা ঝুমঝুমি। “এরেই বুঝি টানা রিক্সা বলে”? স্বামীর সঙ্গে কথা হয় না শাশুড়ির সামনে। তা ছিল নিয়ম ভঙ্গের সামিল। শাশুড়ি জবাব দেন, “দেখেছো কখনও বাপের আমলে? নাও ওঠো এবার”। সেই বিষম বস্তুটায় উঠতে গিয়ে ইন্দুবালা কেঁদে ফেলেন আর কি! রিক্সায় বসার সাথে সাথে রিক্সা বুঝি উলটে যায়। শাশুড়ি চিৎকার করে বলেছিলেন, “বাঙাল মেয়ে কি সাধে বলি? রিফিউজির রক্ত যাবে কোথায়? আমারও যা কপাল”। উঠতে বসতে ইন্দুবালাকে ‘বাঙাল’ বলাটা এই বাড়ির রেওয়াজ ছিল। আর রিফিউজি’ তো তখন কলকাতার আকাশে বাতাসে। কান পাতলেই শোনা যেত। শাশুড়িই ধরিয়ে দিয়েছিলেন ‘বাঙাল’ শব্দটা। পরে বাড়ির লোকের অভ্যেসে পরিণত হয়। মানুষকে এভাবে যে সম্বোধন করা যায় সেটা ইন্দুবালা এপারে না এলে বুঝতে পারতেন না কোনোদিনও। এমনকি গায়ে পড়ে অপমানটাও। অনেক ছোটো বেলায় বাড়ির মাটির দাওয়ায় হেরিকেন জ্বালিয়ে এক সময়ের টোলে পড়ানো দাদু যখন কৃতদাসদের গল্প করতেন তখন শিউরে উঠতেন ইন্দুবালা। সারা দিন কাজ করতো মানুষগুলো। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। উঠতে বসতে মার। জাতের নামে অপমান। গায়ের রঙে অপমান। কাজ না পারলেই অন্ধকুঠুরিতে বন্ধ করে রাখা। এক এক সময় ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িটাকে অন্ধকুঠুরি মনে হতো ইন্দুবালার। মনে পড়ে যেত সেই রাতগুলো। দাদুর গল্প বলার আসরের মাঝে ঠাম্মা এসে কড়া ধমক লাগাতো। “বাচ্চা গুলান রাতে ঘুমাবে সেই খেয়াল আছে তো? থামাও তোমার হাবিজাবি গল্প”। ইন্দুবালা রাতে স্বপ্ন দেখতেন তিনি সেই কৃষ্ণকায় দাসের মতো পিছমোড়া হয়ে বাঁধা আছেন। গায়ে লেখা কতগুলো সংখ্যা। প্রচণ্ড ভয়ে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে ঠাম্মাকে পাশে খুঁজে পেতেন না। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে উঠোন পেরিয়ে ঠাম্মা তখন গোয়াল ঘরে। হরিমতির দুধ দুইছেন, বাছুরকে আদর করছেন। বিচালি আর ভেলি গুড় মাখিয়ে খাওয়াচ্ছেন। ঠাম্মার গা থেকে ভেসে আসছে খুলনার গন্ধ। কলাপোতার গ্রাম। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকেন ইন্দুবালা। পাছে চোখ খুললে স্বপ্নটা যদি চলে যায়।
চোদ্দ গুষ্টি ঘটির মাঝে কেন যে তাঁর শাশুড়ি বাঙাল মেয়ে বউ করে নিয়ে এসেছিলেন সেই সময়ে বুঝতে পারেননি ইন্দুবালা। অনেক পরে বুঝেছিলেন। কিন্তু সেদিকে গল্পের মোড় ঘোরাতে গেলে অনেকটা পথ যেতে হবে। উনুনের আঁচ হবে নিভন্ত। যা ইন্দুবালা কোনোদিনই সহ্য করতে পারবেন না। তাঁর হোটেলে উনুনের আঁচ মানে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। টগবগ করে ফোঁটা ভাতের গন্ধ মানে এই বাড়িতে প্রাণ আছে এখনও। এতদিন পরেও। বাড়িতে জমিদারি আমলের ভাঁড়ারে শাশুড়ি থাকাকালীন চালের অফুরান জোগান না থাকলেও ইন্দুবালার জীবনে প্রাণের অফুরান হয়নি কখনও। বাগবাজার ঘাটে গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম দিনে তাঁর কপোতাক্ষের কথা মনে পড়েছিল। বাড়ি থেকে লাল চেলী পড়ে, গা ভর্তি সোনা নিয়ে চলে আসার সময় মনে পড়েছিল ইচ্ছামতীর কথা। গ্রামের পাশে বোসদের বড় পুকুরটার কথা। সবার কথা স্মরণ করে ইন্দুবালা ছলছল চোখে গঙ্গায় ডুব দিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে বলেছিলেন ভালো থাকুক ইচ্ছামতী…কপোতাক্ষ…বোসদের পুকুর। মাস ছয়ের মধ্যে বড় ছেলে পেটে এলে গঙ্গার পাট চুকলো তাঁর। শাশুড়িও অসুস্থ হলেন।
বুড়ি খিটখিটে হলেও বউয়ের নিন্দা অন্যলোকে তার সামনে করছে কোনোদিন সহ্য করতে পারতেন না। তৎক্ষণাৎ মুখের ওপর জবাব দিতেন। ঠাম্মা শিখিয়েছিল ওপারের রান্না। আর শাশুড়ি খুব যত্ন করে, চিৎকার চেঁচামেচি করে, বাড়ি মাথায় উঠিয়ে শেখালেন এপারের রান্না। ওপারের রান্নায় যেখানে মিষ্টতার অভাব ছিল এপারে এসে সেগুলোতে একটু একটু মিষ্টি পড়লো। আর এপারের রান্নায় মিষ্টি সরে গিয়ে কাঁচা লঙ্কা বাটা এলো। মরিচ ঝাল এলো। চুইঝালের গন্ধ এলো। মৌরির ফোড়ন এলো। সারা বাড়ি ম ম করতে থাকলো ঘটি বাঙালের রান্নার সুবাতাসে। জ্ঞাতি কুটুমরা আড়ালে আবডালে কানাকানি করতো। কিন্তু হাঁড়ির খবর কিছুতেই বাড়ির বাইরে বেরোতে দিতেন না শাশুড়ি। তিনি জানতেন শকুনের চেয়েও হিংস্র হলো ওরা। যারা তার ছেলেকে নরকের দরজায় নিয়ে গেছে। মুখে হাঁ গো কী গো করলেও সারাক্ষণ শাপ শাপান্ত করতেন কুটুমদের নামে। ইন্দুবালাকে পই পই করে শিখিয়েছিলেন, “চিনে রাখ বউ এদের। কোনো শলা পরামর্শ করতে যাবি না ওদের সাথে”। ইন্দুবালা কোনোদিন যাননি। জীবনের চরম বিপদের সময়ও না। শাশুড়ি বুঝেছিলেন এই সংসার ডোবার হাত থেকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তাহলে সে এই বাঙাল মেয়েই। সাধে কি ছবি আসা ইস্তক তিনি ছুটেছিলেন গঙ্গার ধারে মায়ের বাড়িতে? মহারাজ ছবি দেখে বলেছিলেন “শেফালী, তোমার ঘর দুয়ার উত্তরসূরীদের বাঁচাবে এই মেয়ে। লক্ষ্মীমন্ত জেনে রেখো।” একটুও সময় নষ্ট করেননি তিনি আর। নিজের পেটের ছেলেকে ভালো করে চিনতেন। সংসারটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে খুলনার কলাপোতা গ্রামে চিঠি লিখতে বসেছিলেন। চোখের সামনে উজাড় হয়ে ছিল নাতি পুতিদের স্বপ্ন। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো ঘর আলো করে তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিজের চোখে দেখার জন্য বিভোর হয়ে থাকতেন বুড়ি। ইন্দুবালা তাঁর সেইসব স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন যা যা তিনি চেয়েছিলেন ছেলের বউয়ের কাছ থেকে। মুখ ফুটে কোনোদিনও শাশুড়ির মুখের ওপর কথা বলেননি। এক এক সময় নিজেই আশ্চর্য হয়েছেন। কলাপোতার সেই কলবলে মেয়েটা এই ছেনু মিত্তির লেনে এসে কী করে চুপ হয়ে গেল একদম? আসলে হতেই হতো। যে তীব্র যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনার অভিঘাত তাঁর ওপর দিয়ে চলেছিল দিনের পর দিন সেই সবের জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না। নিজেও কোনোদিন ভাবতে পারেননি এমনটা ঘটতে পারে। যে নির্মল ছন্দে জীবনের শুরু হয়েছিল তার পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলেন। চারপাশে এমন একটা মানুষও ছিল না, যাকে মনের কথা বলেন। এরও অনেক দিন পরে এক মাছওয়ালীকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। যে না থাকলে আজকের ইন্দুবালা এমন ভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারতেন না। কিন্তু সেতো গল্পের ধরতাইয়ের দিক। আর এখন এই মুহূর্তে বুকের চাপা কষ্ট কাকে বলবেন ইন্দুবালা? সেইসব কথা কিছুটা জানে কর্পোরেশানের ওই ছিরছিরে জল পড়া কল আর বাগানের আমগাছ, নারকেল গাছ। তার ডালে কদাচিৎ এসে পড়া পাখিগুলো। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না বেরোয় মুখের ভেতর কাপড় খুঁজে নিতেন ইন্দুবালা। শুকনো মাটিতে চোখের জল পড়লে বৃষ্টি নামতো শহর জুড়ে। শাশুড়ি জল ভরা মেঘের দিকে তাকিয়ে তাঁর সংসারের মঙ্গল কামনা করতেন।