সন্ধ্যেবেলা ধনঞ্জয় ধূপ দেখাতে এসে দেখলো কালো বোর্ডে লেখা আছে রাতের মেনু। রুটি, কুমড়োর ছক্কা, শিমাইয়ের পায়েস। ধনঞ্জয় আবার খিটখিট করতে পারতো বুড়ির মেনু চেঞ্জ করার জন্য। কিন্তু আজ সে টু শব্দটি করলো না। বরং বটিটা নিয়ে বড় একটা কুমড়ো কাটতে বসলো। আর কেউ না জানুক সে জানে বড় নাতনি সুনয়নী চলে যাবার পর থেকে আর একদিনও এই বাড়িতে কুমড়োর ছক্কা রাঁধেননি ইন্দুবালা।
২. বিউলির ডাল
ভাদ্রের যে এমন নাভিশ্বাসের গরম আছে ইন্দুবালা আগে কখনও জানতেন না। কিংবা ঠাহর করতে পারেননি তেমন। বিয়ের পর ছেনু মিত্তির লেনে এসে বুঝতে পেরেছিলেন শহুরে দমবন্ধ করা পরিবেশ কাকে বলে। গায়ে গায়ে ঠেকানো বাড়ি। চৌকো খোলা ছাদ। বাড়ির ভেতর থেকে একটুস খানি আকাশ। কর্পোরেশান কলের ছিরছিরে জল। শ্যাওলা ওঠা স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। বড় সোঁদা সোঁদা গন্ধ। আশে পাশে কোনো নদী নেই। পুকুর নেই। তার বদলে বাড়ির সামনে আছে মুখ হাঁ করা বড় বড় নর্দমা। তার দুর্গন্ধ। হুল ফোঁটানো মশা। গা ঘিনঘিনে মাছি। আর সন্ধ্যে হলেই টিমটিমে বিজলিবাতি। এটাই নাকি কলকাতা। এখানে আসার জন্য মানুষ স্বপ্ন দেখে। গড় হয়ে প্রণাম করে না-দেখা কালীঘাটের মায়ের কাছে। বটতলায় সত্যপীরের সিন্নি চড়ায়। মুখের খাবার বন্ধক রাখে ঈশ্বরের কাছে। একবার কলকাতায় আসতে পারলে ট্রাম, বাস, মনুমেন্ট, ফেরিওয়ালার কাছে কাঁচের চুড়ি। এইটুকু সাধের জন্য এতটা কষ্ট করা? শ্বশুর বাড়ির কোনো এক সমবয়সী মেয়েকে কোনো একদিন হয়তো নিজের মনের এই কথাগুলো বলে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা তাঁর সহজ সরল ভঙ্গিতে। তাঁর গেঁয়ো বিদ্যে তখনও শহরের মানুষের জটিল কুটিল মনের তল পায়নি। পরে যে পেয়েছিল তেমনটাও নয়। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিল কোনো এক গাঁয়ের মেয়ের কলকাতাকে দুর-ছাই করার সংবাদে। শাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিলেন “কোথাকার কোন রাজরাজেশ্বরী এল রে। পাকা দালান কোঠায় পা পড়ে না। শুনেচি তো সেখানে শেয়াল কুকুর ঘুরঘুর করতো”। তা ঠিক খুলনার কলাপোতায় সন্ধ্যে হলে বাঁশ বাগানে শেয়াল ডাকতো। তুলসী তলায় জোনাকিরা ভিড় করে আলো জ্বালাতো। মাথার ওপর সারা আকাশ জুড়ে থাকতো তারা। লণ্ঠন লাগতো না। ভাদ্রের এই সময়ে কাঠচাঁপার গন্ধে আকাশ-বাতাস ভরে যেতো। বিয়ের যেদিন সম্বন্ধ এলো অশ্বথ তলায় সেদিন অষ্টপ্রহর। রাজশাহী থেকে এসেছে কীর্তনের নাম করা সব দল। ছানা এসেছে খুলনা শহর থেকে। বড় ভিয়েন বসেছে সামনের বিশালাক্ষী তলার ভোগের ঘরে। এদিকে বাড়িতে ঠাম্মা বানাচ্ছে তুলতুলে নরম মোমের মতো তালের পিঠে। কলাপাতায় গরম গরম সেই ভাপ ওঠা পিঠে আজও যেন ইন্দুবালার চোখে জলছবি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ততক্ষণে অষ্টপ্রহরের মালসা-ভোগের দই চিড়ের জন্য মানুষের কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। ইন্দুবালার তাড়া আছে। সে মালসা ভোগও খাবে। তার সাথে বাড়িতে গিয়ে ঠাম্মার তৈরী তালের পিঠে। এদিকে দূর থেকে ধূর্জটি পিওন আসছে সাইকেলে চেপে। তারস্বরে চিৎকার করছে। বাবার নাম ধরে “ও ব্রজমোহন বাবু … শুনছেন…চিঠি আছে”। চিঠির কথায় ইন্দুবালা ফিরে তাকায়। একটু আড়াল নিয়ে দেখতে পায় বাবার হাতে একটা পোস্টকার্ড। ধূর্জটি পিওন বলে, “মাস্টারবাবু এত ঘনঘন চিঠি আসছে কেন বলুন তো? ইণ্ডিয়াতে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করলেন নাকি? এদিকে কি ছেলের অভাব ছিল? আমার ভাইপো তো এখন ঢাকায় সুতোর কলে কাজ করছে”। উত্তরে বাবা কিছু বলেননি। তাকিয়ে ছিলেন দূরে কপোতাক্ষের ওপার থেকে ভেসে আসা কালো মেঘের দিকে। তিনি জানতেন ওই মেঘে ধরা আছে বৃষ্টির জল। ঠিকঠাক বৃষ্টি হলে ক্ষেতের ফসল ভালো হবে। মেয়ের বিয়ের আর চিন্তা থাকবে না। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিলে তিনি পোস্টকার্ডখানা সাবধানে পকেটে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বাবার পেছন পেছন দূরত্ব রেখে বাড়ির পথ ধরলেন ইন্দুবালা।
ওঁ মা সিদ্ধেশ্বরী সহায়
সম্মানীয়, ব্রজমোহনবাবু
মহাশয়, আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনার পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব হওয়ার ত্রুটি মার্জনা করিবেন। কলিকাতা হইতে খুলনার দূরত্ব বিস্তর। না হইলে আমি স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকিয়া সমস্ত পাকা কথা আপনাকে জানাইয়া আসিতাম। ঈশ্বর সাক্ষী, ইতিমধ্যে অনেক বাক্যালাপই আমাদের পত্র মারফত হইয়াছে। পূর্বের পত্রে আপনার কন্যা ইন্দুবালার যে চিত্রখানি পাঠাইয়া ছিলেন তা আমার পুত্র মাস্টার রতনলাল মল্লিকের বড় পছন্দ হইয়াছে। পাত্রী গৌরবর্ণা, শিক্ষিতা, গৃহ কর্মে নিপুণা, আমার পুত্রের যথার্থ উপযোগী। আপনাদের অমত না থাকিলে এবং করুণাময় ঈশ্বরের কৃপা হইলে এই শ্রাবণে আমার পুত্রের সহিত আপনার কন্যার চারিহাত এক করিবার মনোবাসনা পোষণ করি। যত শীঘ্র সম্ভব আপনাদের মতামত জানাইবেন।
–নমস্কারান্তে
শেফালীরানী মল্লিক
পোস্টকার্ডটি এনে মায়ের হাতে দিয়ে ছিলেন বাবা। ততক্ষণে গোটা কলাপোতা জেনে গেছে ইন্দুবালার বিয়ের ঠিক হয়েছে কলকাতায়। একদিক থেকে ব্রজমোহনকে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছিল সেদিন। কারণ পারতপক্ষে তিনি চাননি মেয়ের এদিকে বিয়ে হোক। ভেবেছিলেন তার সোনার বরণ কন্যের যথাযথ মর্যাদা করতে পারবে ওপারের লোজনেরা। তাই খুব ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বয়সে বেশি দোজবরে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের একমাত্র মেয়ের। বাড়িতে আপত্তি উঠেছিল তীব্র। ঠাম্মা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। মা বলেছিল “এর চেয়ে মেয়েটাকে একটা কলসি আর গামছা দাও না। বোসদের পুকুরে ডুবে মরুক”। ভাইটা ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। হরিমতি দু-দিন দুধ দেয়নি। বিচালিও খায়নি। ভোলা কুকুরটা ঠায় শুয়েছিল দোর ধরে। তবুও কারও কথা শোনেননি বাবা। আর কেউ না জানুক তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন কোনো না কোনো সময়ে বাপ ঠাকুরদার এই ভিটে ছেড়ে তাঁদের একদিন চলে যেতেই হবে। সেদিনের ভয়ে তিনি সারাক্ষণ অতিষ্ঠ হয়ে থাকতেন শেষের দিকে। তাঁকে অবশ্য কষ্ট করে চোরের মতো রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে আসতে হয়নি। খান সেনাদের ঢোকার অনেক আগেই তিনি চোখ বুজেছিলেন কপোতাক্ষের তীরে। বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে। কোনো এক অগ্রহায়ণের শিশিরে ভিজতে ভিজতে। আর বাকিরা জ্বলে পুড়ে মরেছিল স্বাধীনতার আগুনে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হোক, এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এক আশ্বিনের রাতে শিউলির গন্ধে।