তবে আজকে পূর্ণিমা, অমাবস্যা গ্রহণের মারপ্যাঁচ না থাকলেও পায়ের ব্যথাটা যেন বড় বেড়েছে ইন্দুবালার। সকালে পাঁজি খুলে আতিপাতি দেখেছেন কোথাও কোনো বক্র দৃষ্টি নেই গ্রহের। তবুও বাড়ির পেছনে বাগানের সিঁড়িটা দিয়ে নামতেই হড়কে যাচ্ছিলেন আর একটু হলে। কবে থেকে ধনঞ্জয়কে বলে যাচ্ছেন ওরে চুন ফ্যাল। একটু নারকেল ঝাঁটা দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার কর। তা কে শোনে কার কথা। থাকতো সেই আগের বয়স, কারও কাজের জন্য তিনি বসে থাকতেন নাকি? ওই দশ কেজি চালের ভাত নিজে করেননি এক সময়? ফ্যান গালার সময় বাজারের লোকগুলো এসে দাঁড়িয়ে থাকতো জুই ফুলের মতো ভাত দেখার জন্য। ওই কাঁড়ি কাঁড়ি ফ্যান টেনে তুলে দিয়ে আসতেন না পাড়ার কুস্তির আখড়ায়! ছেলেগুলো খেতো পরিতৃপ্তি করে। মা শিখিয়েছিল ভাত হলো লক্ষ্মী। তার কিছু ফেলা যায় না। কিছু ফেলতে নেই। কত মানুষ ওই ফ্যানটুকু খেয়ে বেঁচে আছে দুবেলা। এইসব বকতে বকতে ইন্দুবালা সিঁড়ি দিয়ে নামেন। খিড়কির দরজা খোলেন। সেখানেই তো সেই শাশুড়ির আমলের একটা ছোট্ট বাগান। একটা আমগাছ। একটা পেয়ারা। একটা লিকলিকে নারকেল গাছ খাড়াই হয়ে উঠেছে। এইসব ছাড়াও কয়েক ছটাক জমিতে ইন্দুবালা সাজিয়ে নিয়েছেন তার রান্নাঘরে কাজে লাগার মতো টুকিটাকি সবজি। যেন ফকিরের ঝুলি। কিছু না কিছু তুমি পাবেই। প্রচণ্ড পা ব্যথা নিয়ে এতটা সিঁড়ি ঠেলে বাগানে এসে ইন্দুবালার মন ভালো হয়ে যায়। গোটা বাগান আলো করে ফুটে আছে কুমড়ো ফুল। তার ওপর বিন্দু বিন্দু শিশির। এই ভরা বসন্তে এই সুন্দর সকালে শহরের ইট, কাঠ, পাথরের মধ্যে কোথা থেকে যেন ডেকে উঠলো একটা কোকিল। ইন্দুবালা কুমড়ো ফুলের ওপর হাত বোলালেন। কোথা থেকে যেন পুরোনো কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের এঁদো গলির দোতলা বাড়ির ছোট্ট বাগান হয়ে গেল খুলনার কলাপোতার নিকানো উঠোন। মাটির উনুনে শুকনো খেজুর পাতার জিরানো আঁচ। আর চাটুর ওপর ছ্যাঁক ছুক করে ভাজতে থাকা কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া। নামানোর সময় ঠাকুমা তার ওপর যত্ন করে ছড়িয়ে দিতেন অল্প কিছু পোস্তর দানা। পাশে বাটি হাতে করে বসে থাকা ছোট্ট ইন্দুবালা আর তার ভাই। ঝপ করে একটা সকাল নিমেষে পালটে দিল ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের আজকের মেনু। এক ঝুড়ি কুমড়ো ফুল তুলে নিয়ে এসে দোকানের সামনের কালো বোর্ডে চক নিয়ে লিখলেন ভাত, ডাল, কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া, সরষে মাছ, জলপাইয়ের চাটনি। ধনঞ্জয় গাঁক গাঁক করে উঠলো তার দেশওয়ালি ভাষায়। রেগে গেলে বাংলা তার ঠিক আসে না। আলুভাজা হওয়ার কথা ছিল। সরষে মাছের জায়গায় পটল আলু ফুলকপির ঝোল হওয়ার কথা ছিল। এইসব কিছু ছেড়ে কিনা কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া? ইন্দুবালা কোনো কথা কানে তুললেন না। উত্তর দিলেন না। স্নান করে ধবধবে সাদা কাপড়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।
বেলা যত বাড়তে থাকলো চারিদিকের আকাশ-বাতাস ছেয়ে গেল কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়া ভাজার গন্ধে। সামনের মেস বাড়ির ছেলে-মেয়েগুলো আজ বড় তাড়াতাড়ি ভাত খেতে এলো। কালেক্টর অফিসের কেরানিকুল বাড়ি থেকে খেয়ে এসেও দুপুরে চাড্ডি ভাত বেশি খেতে চাইলো। কবেকার খুলনার এক উঠোন রান্না জড়ো হলো ইন্দুবালার হোটেলে। সবার খাওয়ার তারিফ যখন তিনি রান্না ঘরের মধ্যে থেকে পাচ্ছিলেন, ছেলে-ছোকরাগুলো দিদা বলে এসে যখন জড়িয়ে ধরে আদর করে চলে যাচ্ছিল, বাড়ি যখন ম ম করছে গন্ধে ঠিক তখনই তাঁর সেই পড়ন্ত বেলার হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা ক্যাব। নেমে এলো যে মেয়েটি সেও প্রায় বছর দশেক পরে ফিরছে কলকাতায়। মেয়েটির ছোটো করে কাটা চুল, মেয়েটির হাব-ভাব, মেয়েটির পোশাক, তার বিদেশি লাগেজ, কাস্টমারের ভাত খাওয়ার ছন্দপতন ঘটায়। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে। এই সময়ে এই ছেনু মিত্তির লেনে পরী এলো কোথা থেকে? মেয়েটি সটান গটমট করে এগিয়ে আসে। চোখের রোদ চশমাটা মাথার ওপর তোলে। হেলে যাওয়া ক্ষয়টে এনামেলের বোর্ডে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল তার আমেরিকার প্রবাস জীবনে হারিয়ে যাওয়া বর্ণপরিচয়ে পড়তে অসুবিধে হয় না। দরজার সামনে এক ঘর লোকের মধ্যে অস্ফুট স্বরে ডাকে “ঠাম্মি”।
ইন্দুবালা তখন যত্ন করে শেষ কুমড়ো ফুলের বড়াটা ভাজছিলেন চাটুর ওপর। অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরে ঘুরে তাকান। তাঁর হাতে বেসনের প্রলেপ। কপালে উনুনের আঁচের বিন্দু বিন্দু ঘাম। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা একটু ঠিক করে এগিয়ে আসেন। ভালো করে দেখেন এক পশলা রোদ ঢোকা রান্না ঘরে মেয়েটার মুখটাকে। “নয়ন না?” জড়িয়ে ধরে সুনয়নী তার ঠাম্মিকে। কোনো শব্দ যেন আর বেরোতে চায় না তার গলা থেকে। শুধু ফোঁপানো কান্নায় বোঝা যায় ভাঙা ভাঙা কথা। “আমায় একটু তোমার কাছে থাকতে দেবে ঠাম্মি?” ইন্দুবালা কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না। তাঁর বড় ছেলের এই মেয়েটি ঠিক তাঁর মতোই। একরোখা। কারো কথা না শুনে, কাউকে তোয়াক্কা না করে কলেজ টপকে চলে গিয়েছিল বাইরে। কোন এক বিদেশিকে বিয়েও করেছিল মনে হয়। তারপর আর কেউ খবর রাখেনি। মেয়েটা যে এই বাড়ির কেউ ছিল, এই বাড়ির কেউ হয় সে কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল সবাই। শুধু নতুন বছরে একটা করে কার্ড আসতো ইন্দুবালার কাছে। ফুল, লতা পাতা, সূর্য দেওয়া। ইংরাজিতে লেখা থাকতো অনেক কিছু। ইন্দুবালা ওগুলো সাজিয়ে রেখে দিতেন দেওয়ালে। সেই নয়ন? “আমাকে ভুলে যাওনি তো ঠাম্মি? সবাই ভুলে গেছে আমাকে। বাবা, ভাই, কাকু, পিসি সবাই”। ইন্দুবালা নাতনির থুতনি ধরে চুমু খান। তাকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন রান্না ঘরের ছোট্ট টুলটায়। সামনের টেবিলে শালপাতার থালায় নিজের হাতে ভাত বাড়েন। মাটির গ্লাসে জল দেন। “আমার ঠাকুমা কী বলতো জানিস নয়ন? দুপুরের অতিথি হলো মেঘ না চাইতে জল। তাকে পেট পুরে না খাওয়ালে গেরস্তের অমঙ্গল হবে। মাঠ ভরা ধান হবে না। গোলা ভরা ফসল উঠবে না। মা লক্ষ্মী বিরূপ হবেন। ভিটে মাটি ছাড়া করবেন”। সুনয়নী ডুকরে কেঁদে ওঠে। তার যে ভিটে মাটি কিছু নেই আর। সব গেছে। ইন্দুবালা মেয়ের মাথায় হাত বোলান। মিষ্টি কুমড়ো ফুলের বড়া মুখের সামনে ধরে বলেন, “দ্যাখ তো দিদিভাই মনে পড়ে কিনা কিছু”? সুনয়নীর কিছু মনে পড়লো কিনা বোঝা যায় না। তখন সে তার সদ্য ছেড়ে আসা স্প্যানিশ বয় ফ্রেণ্ডের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্যাকুল। কিন্তু ইন্দুবালার মনে পড়লো অনেক কিছু। সুনয়নীর জন্ম হয়েছিল এমনই এক ঝলমলে দুপুরে। সেদিন ছিল বাসন্তী পুজো। তিনি সারাদিন উপোস করেছিলেন। বাটিতে ভেজানো ছিল নতুন ছোলা। কুমড়ো গুলো ডুমো ডুমো করে কাটা ছিল। দয়া গোয়ালিনী দিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে পাতা ঘি। ইচ্ছে ছিল কুমড়ো ছক্কা রাঁধার। সেদিনও এমন বিকেল হয়েছিল সব কিছু সারতে। বাড়িতে পাতা ঘি আর হিংয়ের গন্ধ ওঠা কুমড়োর ছক্কায় সারা বাড়ি যখন ম ম করছে। তখনই খবরটা এলো হসপিটাল থেকে। বাড়িতে কত দিন পর নতুন লোক এলো। নাতনির টানাটানা চোখ দেখে ভেবেছিলেন সত্যি ঠাম্মাই বুঝি ফিরে এসেছেন খুলনার কলাপোতার বাড়ির সব মায়াটুকু নিয়ে। চোখ চিকচিক করে উঠেছিল ইন্দুবালার। বড় আদর করে প্রথম নাতনির নাম রেখেছিলেন সুনয়নী।